পার্ক-স্ট্রিট থেকে মহিনের ঘোড়াগুলো; গৌতম ছিলেন বাঙালী হৃদয়ে
বাংলা গানের জনপ্রিয়তা সেই সত্তর – আশির দশক থেকেই। কি তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে এখনো মানুষের মাঝে বেঁচে আছে ‘হায় ভালোবাসি’, ‘কত কি করার আছে বাকি’, ‘এই মুহূর্তে’, ‘টেলিফোন’, ‘এ কি কথা শুনি হায়’ এর মত কালজয়ী সব গান।
গান তো সকলের হৃদয়ে দাগ কেটে গেঁথে আছে, কিন্তু এই গানগুলোর পেছনে যে মানুষটা, যে এমন কালজয়ী সব গান সৃষ্টি করে গেছেন গানের প্রতিটি লাইনে সে ও মনেই থেকে যায়। গৌতম চট্টোপাধ্যায়। নকশাল থেকে যে বাংলা গানকে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছেন।
১৯৪৮ সালের ১ জুন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গৌতমরা ছিলেন পাঁচ ভাই। তাঁর বাবা পেশায় বিজ্ঞানী হলেও বরাবরই ছিলেন সংগীত রসিক। সেই সুবাদে বেহালার বাড়িতে চিরকালই গানবাজনার চর্চা ছিল। নানা ধরনের শিল্পী এসে গাইতেন গান। যার বেশির ভাগটাই ছিল শাস্ত্রীয় সংগীত। যে কোনও ইনস্ট্রুমেন্টই খুব সহজে বাজিয়ে ফেলত। তবে তবলায় বিশেষ দক্ষতা ছিল গৌতমের। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজে মনোবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন তিনি। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে একটি ব্যান্ড তৈরি করেন। ব্যান্ডের নাম দেন ‘দ্য আর্জ’।
ষাট – সত্তরের দশকে পার্ক স্ট্রীটে তখন একদল যুবক গানের আসর বসাতেন। তাদের মধ্যেই মনি নামে ছিল এক ফর্সা, রোগা মুখ ভর্তি দাড়ি নিয়ে একটা ছেলে। পুরনো হাওয়াইয়ান গিটারটাকে স্প্যানিশ করে নিয়ে চলছে বিটলস, বব ডিলান, জিম মরিসনের সব ইংরেজি বিখ্যাত গান। কলেজে গৌতম চট্টোপাধ্যায় তখন পরিচিত মুখ। বিখ্যাত সব ইংরেজি গানকে নিজের বাঙালি সত্ত্বার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
তিনি বলতেন সংগীতচর্চার আদর্শ সময় নাকি মধ্যরাত। তাই দুই একদিন পরপরই ড্রামস-গিটার নিয়ে গান শুরু করতেন মাঝরাতে। ফলে ‘বাধ্য’ হয়েই প্রতিবেশীরা সেই বাড়ির পাঁচিলে গোপনে লিখে রেখে গিয়েছিলেন ‘আস্তাবল’। তারা ভেবেছিলো হয়তো এতে কোন কাজ হবে। কিন্তু উল্টো ব্যাপারটাকে ‘কমপ্লিমেন্ট’ হিসেবেই নিয়েছিলেন তিনি ও তার দল। সেসময় তিনি বলেছিলেন, এর কিছু দিন পরে ওই আস্তাবল থেকেই জন্ম হবে একটা মস্ত বিপ্লবের। বাংলা আধুনিক গানের গতিপ্রকৃতি বদলে দেওয়ার স্বপ্নের বীজ রোপণ হবে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র হাত ধরে। আর গৌতম চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠবেন আস্ত একটা প্রজন্মের ‘মণিদা’। নতুন বাংলা গানের জীবন্ত ‘আইকন’।
বিএসসি শেষ করে গৌতম ঠিক করেছিলেন পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে গিয়ে ছবি তৈরির কলাকৌশল শিখবেন, নিজের মতো করে। কিন্তু এরমধ্যেই গোটা বাংলায় ডাক পড়ে নকশালবাড়ীর আওয়াজ। দলে দলে ছাত্র, যুবক যোগ দেয় নকশাল আন্দোলনে। জড়িয়ে পড়েন গৌতমও। সারাক্ষণ সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন রেডবুক। ক্রমশ বাড়ি ফেরা কমতে শুরু করল। বলা যায় সেখান থেকেই নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করেন তিনি। সে সময় বাড়ি ফেরা একেবারে বন্ধ হল মণির। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন পার্টির কাজে। কিন্তু গিটারটি ছাড়লেন না। আর তখন মনে এলো ইংরেজি গান দিয়ে তো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে। এদের কাছে পৌঁছাতে হলে এদের ভাষায় গান লিখতে হবে। রাজনীতির পাঠ গৌতমকে বুঝিয়ে দিয়েছে, রেস্তরাঁর এলিট গ্রাহকদের সামনে ইংরিজি গান গেয়ে বিপ্লব তৈরি হবে না। তার জন্য বাংলায় গান বাঁধতে হবে, বাংলার নিজস্ব সুরে। গানের ভিতরে জাগবে মানুষ। সেই মানুষের কথা বলতে হবে গানের ভেতর। রক্ত-মাংস-ঘামের কথা উঠে আসবে গানের রক্ত মাংস মজ্জার শরীরে। শুরু হল ‘মহিনের ঘোড়াগুলো’র পথচলা। শুরুতে যদিও নাম ছিল সপ্তর্ষি। একেক পর এক বাংলা গান উপহার দিলেন। যেগুলো আজো হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে৷
অবশেষে একদিন গৌতম ফিরলেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে, অতি গোপনে। ফেরার পথেই গৌতম এবং তাঁর আরও দুই ‘কমরেড’কে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। জানা যায়, এক বন্ধুকে তাঁর চোখের সামনেই ভুয়ো এনকাউন্টারে মেরে ফেলে ছিল পুলিশ। দীর্ঘদিন জীবনের থ্রেট ছিল গৌতমের উপরও। এরপর তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশ লক-আপে পাওয়া যায়। যদিও এতো নির্যাতনের পরও তিনি কোন প্রকার তথ্য প্রকাশ করেননি। দীর্ঘ দেড় বছর জেলে থাকার পর গৌতম অবশেষে মুক্তি পেয়েছিলেন একটাই শর্তে, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকতে হবে তাঁকে। আশ্চর্যের বিষয় হল, জেল জীবনে অসংখ্য গান লিখলেও, একটিও রাজনৈতিক গান লেখেননি গৌতম। সবই কেমন রোমান্টিক গান। তেমনই একটি গান ‘নীল সাগরের অতল গভীরে’। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রাজনীতির থেকে খানিকটা সরে আসেন তিনি। চলে যান ভোপাল। সেখানে গিয়ে পেয়ে গেলেন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ। এরপর যান জব্বলপুরে। মিনতি বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে তিনি আবদ্ধ হয়েছিলেন।
মহীনের ঘোড়াগুলি ১৯৭৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলা স্বাধীন রক ব্যান্ড। এটি ভারতের প্রথম রক ব্যান্ড যা ১৯৭০-এর দশকের মাঝ পর্বে কলকাতায় যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক (১৯৭৭), অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব (১৯৭৮) এবং দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি (১৯৭৯); এই তিনটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তবে তখনো তিনি তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি। ১৯৯৫ সালে সমসাময়িক বিভিন্ন শিল্পীদের সমন্নয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায় ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ শিরোনামে মহীনের ঘোড়াগুলির একটি কভার সংকলন প্রকাশ করে। জীবনমুখী গান এবং নৈতিক সংগীত দর্শনের কারণে বর্তমানে তাদেরকে বাংলা গানের পথিকৃৎ বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
সাত জনের এই দলের নাম হয়ে গেল ‘সপ্তর্ষি’। আশির দশকের প্রারম্ভে ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। মনস্থির করতে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ও কলকাতায় চলচ্চিত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অপরদিকে বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় পাড়ি জমান সান ফ্রান্সিসকোতে, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় তার প্রকৌশলী জীবনে মনোযোগ দেন, রঞ্জন ঘোষাল বেঙ্গালুরুতে বিজ্ঞাপন আর থিয়েটারে যুক্ত হয়ে পড়েন, এব্রাহাম মজুমদার জার্মানিতে মিউজিক স্কুল চালু করেন, তাপস দাস কলকাতায় চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে কাজ শুরু করেন। আর তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ দেন তার নিজের কর্মজীবনে।
১৯৯৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। তাঁর তৈরি সিনেমা ‘নাগমতী’ পেয়েছিলো জাতীয় পুরস্কার। কিন্তু মহীনের মর্যাদা দেখে যেতে পারলেন না। তার আগেই নেমে এল মৃত্যুর থাবা। অমর সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে সারাজীবন বেঁচে থাকবেন।