নারীরা কবে পুরোপুরি আত্মনির্ভরশীল হবে
জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের সভ্য বলে দবি করি। কিন্তু সভ্য জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্য সর্বদাই আত্মনির্ভরশীলতা, মর্যাদাসম্পন্ন ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া। এক্ষেত্রে বাঙালির মধ্যে সেই চর্চা কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে আমরা শুধু একে অপরের ওপর নির্ভরশীলই নয়, বরং ব্যক্তির সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চর্চাটাও পুরুষতন্ত্র সমানতালে চালিয়ে যায়।
একজন অন্যজনের সঙ্গে কতটুকু দূরত্ব বজায় করে চলবে, নির্ভরশীলতার পরিমাণ কেমন হলে দু’পক্ষেরই মঙ্গল, সেটা আমরা ভাবি না। ফলে অযাচিতভাবে একে অন্যের দাসত্ব করতে ও করাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। ব্রিটিশ শাসন শেষ হলেও বাঙালির মননে যে দাসত্বের ভূত আজও রয়ে গেছে। দাসপ্রথা নামেমাত্র বিলুপ্ত হয়েছে। বাস্তবে পরিবর্তিত রূপে এসে ভিড়েছে নারীর চেতনায়। তবে এক্ষেত্রে নারীকে এই পথে পরিচালিত করে পরিবার, সমাজ। তাই নারীর আত্মমর্যাদা, আত্মনির্ভরশীলতা বড় না হয়ে পারিবারিক ও সামাজিক বিধিবিধান, রীতি-নীতি বড় হয়ে দেখা দেয়। সেই চেতনার ধারক-বাহক হয়ে নারীও দাসত্বে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নারী নিজের মত-পথের গুরুত্ব না দিয়ে বাবা-ভাই-স্বামীর হাত ধরে জীবন পান করে দেয়।
পরিবার থেকে এভাবেই গড়ে তোলা হয় যে, বিয়ের পর নারীদের প্রধান এবং একমাত্র অবলম্বন স্বামী। স্বামীই তাদের সর্বস্ব, স্বামীই দেবতা। কিন্তু বর্তমান নারীরা ঘরের বাইরেও নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। দেশ ও দেশের বাইরেও তাদের সমান বিচরণ। তবু মান্ধাতা আমলের যে প্রথা, তা থেকে তারা পরিপূর্ণরূপে বের হতে পারেনি। এমনকি বের হতে দেওয়াও হয় না।
পুরুষের চেয়ে নারীরা পরিবারের ওপর বেশি নির্ভরশীল। তবে নারীরা নির্ভরশীল হয়ে ওঠে না, তাদের নির্ভরশীল করে তোলা হয়। শিশুকাল থেকেই একজন ছেলে সন্তানকে যতটা বহির্মুখী করে গড়ে তোলা হয়, কন্যাসন্তানকে ততটা নয়। বরং কোনো কেনো পরিবারে যে মেয়ে বাচ্চা আছে, এমনটাও প্রতিবেশীদের জানার বাইরে থাকে। বিষয়টা নিয়ে পরিবারের সদস্যরা রীতিমতো গর্ববোধ করে। ফলে নারীরা শৈশব থেকে এত বেশি ঘরমুখো হয় যে, তাদের নির্ভরশীলতাও মজ্জাগত হয়ে পড়ে। হুট করে বিপ্লব ঘটিয়ে নিজের অধিকার বা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে নারীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নারীরা বাবার বাড়িতে যেমন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বাবা-ভায়ের দেখানো পথে চলে, তেমনি জীবন পরিচালনা করতে আরও একটু বাড়তি সংযোজন ঘটে স্বামীর পরিবারে এসে।
স্বামীর মত-অমত; সবটাই মেনে নিয়ে জীবন পরিচালনা করতে হয় নারীকে। ভালো-মন্দের তফাত সম্পর্কে কোনো অভিমতকেও কেউ পাত্তাই দেয় না। আর নারী আগেই যেহেতু অভ্যস্ত থাকে, সেহেতু তারাও সব মেনেই চলে। কিন্তু কথা একটাই, মানুষ স্বাধীন। মত-পথ স্বাধীন। এটাই স্বাভাবিক। দুজনের সম্মিলিত প্রয়াসে ভালোভাবে জীবন পরিচালনা করার মধ্যেই রয়েছে সুখ, সমৃদ্ধি। কিন্তু বেশিরভাগ পরিবারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে পুরুষের কথাই শেষ কথায় হয়। নারী সেখানে নামমাত্র সদস্য। এরপরও এই নারীরাই স্বামীকে সর্বস্ব জ্ঞান করে। শুধু তাই নয় স্বামীকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করতে শুরু করে। এতে খারাপ যেটা ঘটে, নারীর সঙ্গে অন্যায়-শোষণ-নিপীড়ন চললেও তা মুখ বুজে সহ্য করে। ফলে পুরুষতন্ত্র আধিপত্য বিস্তার করে নিজেদের প্রভু ভেবে নারীকে শুধু ভৃত্যের মতো আচরণ করতে থাকে। আর পরিবার থেকে যে শিক্ষা দেওয়া হয় স্বামী স্বর্গ, স্বামী দেবতা, স্বামীই সব। এই ধারণা মনে পুষে আসছে এখনো।
নারীকে পরিবারে শিক্ষা এত বেশি আলোড়িত করে যে, নিজের অধিকারবোধ সম্পর্কেও তারা অন্ধ হয়ে যায়। সারাক্ষণ স্বামী, পরিবারের মঙ্গল কামনায় নিজের শরীরের যত্ন পর্যন্ত নেওয়া ভুলে যায়। স্বামীসর্বস্ব, স্বামী দেবতা ভাবতে ভাবতে নিজের ভালোর চিন্তা তাকে ভাবিত করে না। আর সমাজও নারীকে ভাবতে বাধ্য করায় পতিই সব। কারণ যে নারীরা বিধবা বা ডির্ভোসি বা চিরকুমারী থাকতে চায়, তাদের সেভাবে থাকতে দেওয়া হয় না। সেখানে পরিবার, সমাজ সবজায়গা থেকে নারীকে বিপদের ঈঙ্গিত দেওয়া হয়। নারীকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকায় অসহযোগিতা করা হয়।
পরিবার-সমাজের এই নোংরা, পচা চিন্তাধারা না বদলালে নারীরা পণ্যের মতো শুধু নিজেদের সেবা দিয়ে যাবে কিন্তু বিনিময়ে নিজের যোগ্য সম্মাান, মর্যাদা পাবে না। যদি নারীরা নিজেদের মতোই আরেক মানুষের প্রতি দেবত্ব আরোপ না করে তাকেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, তবে হয়তো এই পরিস্থিতি বদলাবে। সংসারের সব দায় একার কাঁধে নিয়ে নিজেকে ভারবাহী করার মানে হয় না। বরং দায়-দায়িত্ব সমান, সম্মান-মর্যদা সমান। স্বামীই তাদের সর্বস্ব নয়, দেবতা নয়; এই কথা মেনে নিজের ভালো-মন্দ বুঝে জীবন পরিচালনা করা এবং অত্যাচারের সম্মুখীন হলে তার পরিত্রাণ ঘটানোই হোক নারীর আগামীর ব্রত।