ঘরে বাহিরে শাঁখের করাতের জীবন
কোনো সমাজে নগরায়ন কিংবা আধুনিকায়নের ফলে পরিবর্তনের যে স্রোত চলমান থাকে তা সচরাচর অপরাধ ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে স্থবির করে দেয়। এক সনাতনী সমাজ ব্যবস্থা থেকে আমরা আধুনিক সমাজব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এই সনাতনী ব্যবস্থা এবং আধুনিকায়নের মধ্যবর্তী এক অবস্থায় রয়েছে সমাজ। কোনোদিকেই আমরা যেতে পারিনি। আর এই দুইয়ের পেশনে শাণের করাতের জীবন নারীর। নারী আজ ঘরের কোণ থেকে বাইরে। কখনও চাকরি কিংবা উদ্যোক্তা, অনেক ভূমিকায় তাকে দেখা যাবে। তবে অর্থনৈতিক অগ্রসরতায় নারীকে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় উদ্যোক্তা হিসেবে। ঘর আর ব্যবসা দুটো চালানো সহজ। ঘর তাকে সামলাতে হয়ই। অনানুষ্ঠানিক এই খাত নিয়ে তো কোনোদিন কথা হয়নি তবে শছরে শিক্ষিত তরুণের অনেকেই বলে বেড়ান নারীরা অনেক সুযোগ সুবিধা পান। সুযোগ-সুবিধা নারীকে দেয়া হচ্ছে তা সত্য। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর আচরণ কি বদলেছে? এই দীর্ঘদিনে আমরা বুঝতে পেরেছি পুরুষতন্ত্র শুধু পুরুষ নয়। এই পুরুষতন্ত্র একজন পুরুষকেও দমিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু নারী এখানে যেন কলের পুতুল। তাকে দম দেওয়া হয় আর দম ফুরিয়ে গেলে সাজিয়ে রাখা। নারীর সুবিধা ওই দম দেওয়া কলের মতোই। ভেতরটা ফাঁপা।
যেমনটা বলেছি, সনাতনী সমাজব্যবস্থা থেকে আধুনিক জীবনে পরিবর্তনের যাত্রায় আমরা থিতু হইনি। আধুনিক জীবনে নারী কি নিয়েছে? সে শিক্ষার সুবিধা পেয়েছে, নানা অর্থনৈতিক খাতে যোগ দিতে পেরেছে। কিন্তু এতটুকুই তো। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর অবস্থান কী? সেটা তো জানাই নেই। আধুনিক নারী পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অনেক সুবিধা নিয়েছে। তাদের সচেতনতার জায়গা। আবার আধুনিক বিশ্বের বিভ্রমও তারা মুভি বা মিডিয়া থেকে নিয়েছে। আর এই নেওয়া শুধু নারীই নেয়নি। সনাতনী ব্যবস্থার ভাবধারা কিছুটা হলেও আজ আমাদের মনে কাজ করে। ভারতীয় সিরিয়ালে একজন নারী যখন ঘরের বউ তাকে সবকিছুতেই পার্ফেক্ট হতে হয়। আর পারফেকশন এতটাই অদ্ভুত যে মাঝেমধ্যে হাসির খোরাক হতে হয়। উদাহরণ হিসেবে এক সিরিয়ালে এক নারীর প্লেনচালনার দৃশ্যের কথা বলতে পারি। আরও অনেক আছে। ভারতীয় সিরিয়ালগুলো দেখলে আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসাহাসি করি। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন, এই নাটক বা সিরিয়ালের যদি চাহিদা না থাকতো তাহলে কি এখনো এগুলো দেখা হতো? বাড়ির এক বউকে তার অধিকার বা প্রাপ্য সম্মান আদায়ের জন্য নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আবার অনেক সময় সেই বউকে অসাধ্য সাধন করতে হয়। সে চিকিৎসককে কাঁচকলা দেখিয়ে স্বামীকে জীবিত করে তোলে। এমন অস্বাভাবিক বিষয়গুলো সাংস্কৃতিকভাবে একটি বিষয়কে প্রমাণ করে। মেলোড্রামাটিক এই নাটক একজন আদর্শ গৃহিনীয় আধুনিক ও সনাতনী সংঘর্ষের আল্টিমেট প্রোডাক্ট বলেই মনে হয়। কি অদ্ভুত। খুবই অদ্ভুত।
আমাদের সমাজে এখনও সনাতনী ভাবনা রয়ে গেছে। নারীর মধ্যেও রয়েছে। সাবলম্বী নারীর মধ্যে মাতৃত্বের চেতনা সচেতনতা ছাড়িয়ে অনেকটা পরিবারের প্রত্যাশার ওপর নির্ভর করে। এখন অনেক স্বামীই নারীকে সহযোগীতা করেন। কিন্তু পরিবার কাঠামো একক হিসেবে আধুনিক বিশ্বে যেমন আমাদের এখানে তেমন না। একটু ভিন্ন তো বটেই। শ্বশুর আছে, শাশুড়ি আছে। তাদের প্রত্যাশার মধ্যে সনাতনী ভাবনা আছেই। হয়তো অনেক জায়গায় কমেছে। কিন্তু আমরা বলতে পারবো না সবখানেই এমন আধুনিকায়ন হয়েছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজকাল ভিডিও দেখা যায়। নারী শ্বশুর-শাশুড়িকে সহ্য করতে পারে না। অবচেতনে মানুষের মনে এসব ভিডিও ছড়ায় সন্দেহ। ভিডিওর এই ভয়ংকর ক্ষমতা রয়েছে। আমার এক পরিচিতর একটি ঘটনা। আমার নিকটাত্মীয় বলা যায়। গ্রাম থেকে সুন্দর একটি মেয়ে বাছাই করে বিয়ে করানো হয়। অভিভাবকদের মতে গ্রামের মেয়ে সরল। তারা শ্বশুর-শাশুড়ির যত্ন নিতে জানে। সেই মেয়েটিকেই প্রথমদিন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দেখেছি। প্রথমেই শাশুড়ি তাকে বলছেন, ছেলে আলাদা করার চিন্তা করবানা। এসব বিষয় শুরুতেই বিভাজন গড়ে দেয়। আত্মার মিলটার মধ্যে একটা তিক্ততা ঠেলে দেয়। সেদিন চুপ করে বসে ছিলাম। বলতে পারিনি কিছু। সনাতনী সেই মন থেকে মুক্তি তো নই।
এই সনাতনী মনকেই বোধহয় বলতে হবে কালচারাল হেজেমনি।
ভারি শব্দ। কিন্তু একটা চক্র। নারীর ওপর দায়। তার জীবনের মূল উদ্দেশ্য দায়-দায়িত্ব। এখন সাহিত্যের অনেক বর্ণনাকেও গভীরভাবে অনুধাবন করতে হয়। গ্রাম্য মেয়েকে কিছুদিন উড়তে দেওয়া হয়। শৈশবের ঐ কিছুদিন সময়ে নীলকণ্ঠ পাখির মতো ফুটে বেড়ায়। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে একটু দৌড়ঝাঁপ। বরইতলায় বরই বা তেতুলতলায় যাওয়া। কতদিন মাছ ধরা। এই ছুটন্তপনা গ্রামের অনেক মেয়েকে সংসারে গিয়ে খুইয়ে দিতে হয়। আমাদের গ্রাম এই সনাতন থেকে বের হয়নি। সন্তান আধুনিক যুগের বিভ্রমে পড়ে কিশোর গ্যাং এ জড়িয়ে পড়ছে। মাদক, আর অন্য অনেক কিছুতে জড়িয়ে পড়ছে। মা অন্যায় আশ্রয় তাকে দিচ্ছে। সমাজ তাকেও দায় করছে। আজও আমাদের সমাজে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে গালি দিলে তা মা-কেন্দ্রিক কেন হয়? সমাজে এই ফোকলোর বা নর্মস কিভাবে গড়ে ওঠে? নারীর অবস্থান ঠিক কোথায়?
নারীকে দায়ি করার সাংস্কৃতিক আলামত কি অচিহ্নিত? নাকি আমাদের চোখে কিছু নেই। সন্তানকে স্কুলে পাঠাও। যদি মা চাকরি করেন তাহলে ঘরে সন্তানের দেখভালের জন্য বুয়া রাখো।
পশ্চিমা বিশ্বের মতো বেবিসিটার আমাদের এখানে আসেনি। আবার চাইন্ডকেয়ার আসলেও তা সবার সাধ্যের মধ্যে না। আধুনিক সুযোগ- সুবিধা কাঠামোর কিছুই তো মায়ের নেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি পাচ্ছে। তবে সবখানে কি এই সুবিধা নেয়া যায়? অবশ্যই না। দেশের সংকট ও চাকরির বাজার প্রতিযোগীতামূলক। নারী উদ্যোক্তা হতে হলে টাকা জমায়। অনেক কষ্টে টাকা জমায়। আবার ঋণ নিতে গেলে তাকে স্বামীর সাহায্য নিতে হয়। এমন অনেক ঘটনাই আছে যেখানে স্বামী স্ত্রীর টাকা জোর করে নিয়ে গেছে। ঋণের বোঝা তার ঘাড়েই। সন্তান একটু বিপথে গেলে মায়ের দোষ। সংসারের সব আশা- আকাঙ্ক্ষা মাকে ঘিরে। কোথায় একটুকু ফুরসত মিলবে মায়ের? তা সত্যিই জানা নেই। আর এখানেই সবকিছু কেমন অদ্ভুত। এসব নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপট কম হয়নি। সমাজে ভাবনা বদলে নি।
নারী আয় করবে। তার আয়ে সবাই খুশি। কিন্তু স্বামী তখন একটু চাপমুক্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্বামী পরিবারেই আর মনোযোগ দেন না। নারীর টাকাই সম্বল। কিন্তু নারীকে আরও অনেক কাজ করতে হয়। এখনও কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ওয়াও। পশ্চিমা বিশ্বের মত ফ্রিজ থেকে বের করে গরম করলে হয় না। আধুনিক বিশ্বের সহনশীলতা আমরা নেইনি। নারীকে সুযোগ দিয়েছি কিন্তু তার সহনশীলতার বিষয়টিকে এখনও সনাতনী মন দিয়ে দেখছি। এ এক শাণের করাতের জীবন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, নগরায়ন ও উন্নয়নে এই অবস্থা থাকেই। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনও এই স্থিতাবস্থা দূর হচ্ছে না।না হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। নারীর নিরাপত্তা নেই। অথচ আমরা ভাবি আছে। নানা যুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। পরিসংখ্যান, সামাজিক কাঠামো এমনকি সাংস্কৃতিক আবহও কিন্তু অন্য কথা বলে। অবশ্য ঘরের ভেতরে কেউ পরিসংখ্যান নিতে যায় না। তাহলে আর বিস্তারিত জানার সুযোগ আসবে কোথা থেকে?