অন্দরসজ্জায় বেতের আসবাব
নতুন সংসার শুরু করেছেন কিংবা নতুন বাসায় উঠে নতুন সব আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজাতে চান বলে সাশ্রয়ী দামের আসবাবপত্র খুঁজছেন? সেক্ষেত্রে বেতের আসবাবপত্র জুড়ি মেলা ভার। আবার যদি হয়ে থাকেন শিল্পমনা বা ঘরে রাখতে চান বাঙালির ঐতিহ্যের স্পর্শ, তাহলে আপনার পছন্দের তালিকায় প্রথমেই থাকবে বেতের আসবাবপত্র। ৮০ দশকের দিকে যদি ফিরে যাই উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত; সবার ঘরেই থাকতো বেতের আসবাব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচির পরিবর্তন আসার পর বেতের জিনিসের ব্যবহার কিছুটা কমে গিয়েছিল। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া বেতের আসবাব আবার বাঙালির ঘরে ঘরে ফিরে আসছে। বেতের আসবাব যেমন ঘরের শোভা বাড়িয়ে দেয়, তেমন রুচিরও পরিচয় দেয়।
বেতের আসবাবপত্র নিয়ে খুঁটিনাটি কথা হয় অর্পা’স (Arpa’s) প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা রিপন ঘোষের সঙ্গে। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে অনলাইন ও শো-রুম দুই মাধ্যমেই বেতের আসবাব নিয়ে কাজ করছেন। রিপন ঘোষ জানান, সিলেটে বাণিজ্যিকভাবে বেতের চাষ করা হয়। বাংলাদেশের বেত শিল্প মূলত গড়ে উঠেছে সিলেটকে কেন্দ্র করেই। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে বেত গাছ, সেখানে বাইজ্জা প্রজাতির বেত রয়েছে৷ আর সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মুলি বাঁশ, এটি সারাদেশেই কমবেশি পাওয়া যায়৷
বাংলাদেশে আরও নানা প্রজাতির বেত রয়েছে। যেমন—তল্লা, বইরা, জালি, গোল্লা, মাকলা, করজবা, ভুদুম বাঁশ ইত্যাদি৷ গৃহসজ্জার সব অনুষঙ্গ বেতে দিয়ে করা যায়। তবে সব ধরনের বেত দিয়ে কিন্তু গৃহসজ্জার অনুষঙ্গ তৈরি করা যায় না। এটির জন্য প্রয়োজন হয় জালি ও গোল্লা বেত৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ইকো ফ্রেন্ডলি আসবাবের জন্য বেতের আসবাবের জনপ্রিয়তা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো।
আপনার বসার ঘরের শোভা বাড়াতে যে খুব দামি কাঠের কারুকাজ করা সোফা সেট ব্যবহার করতে হবে এমন নয়। বসার ঘরের সেট হতে পারে বেতের সোফা। এটি যেকোনো সাধারণ ঘরকেও অনেক বেশি নান্দনিক করে তুলবে। বাজারে বেতের গোলাকৃতি সোফা সেট পাওয়া যায়। ড্রয়িংরুম বড় হলে সোফার পাশাপাশি ঘরের কর্নারে রাখতে পারেন বেতের আর্মচেয়ার। আর্মচেয়ারে কুশন কিংবা গদি ব্যবহার করতে পারেন। একঘেয়ে কাঠের বিছানা না কিনে বেডরুমের জন্য কিনতে পারেন বেতের বিছানা৷ এতে নিঃসন্দেহে অন্য যে কারো থেকে আপনার বেডরুম হয়ে উঠবে আকর্ষণীয়। এছাড়া বারান্দায় রাখতে পারেন বেতের দোলনা, এতে আপনার বারান্দার সৌন্দর্য বেড়ে যাবে।
দোলনায় রাখতে পারেন নানা নানা রঙের কুশন। ইনডোর প্ল্যানস রাখতে পারেন বেতের ঝুড়িতে, এটি আপনার ঘরের একটি শোবিজ হয়ে যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে গাছে আকৃতি ভেদে বেতের ঝুড়ি কিনতে হবে। আজকাল ঘরে শুধুই বেতের আসবাবের থিম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ পুরো ঘর কিংবা কোনো রুম সাজানো হয় শুধু বেতের আসবাব দিয়ে৷ সেক্ষেত্রে সিলিংয়ে ঝুলিয়ে দিতে পারেন বেতের লাইটিং। দেয়ালে সেট করা যেতে পারে হরেক রকমের বেতের সেলফ, সেখানে সাজিয়ে রাখতে পারেন বই কিংবা ক্যাকটাসের মতো ছোট ইনডোর প্ল্যানেট। আবার দেয়ালে সেট করতে পারেন বেতের আয়না। এতে রুম আরও বেশি নান্দনিক হয়ে উঠবে৷
রুমে রাখতে পারেন বেতের স্টোরেজ সেখানে টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে রাখা যাবে। কিংবা গয়না ও চুড়ি গুছিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করতে পারেন বেতের বক্স। আপনার বারান্দায় রেখে দিতে পারেন দুটি বেতের মোড়া। মেহমানদারীতে খাবার পরিবেশনের জন্য ট্রে একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ, সেক্ষেত্রেও বেছে নিতে পারেন বেতের ট্রে৷ ঘরের কোনায় প্লাস্টিকের ডাস্টবিন রেখে দিলে অনেক সময় ঘরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়, তাই প্লাস্টিকের পরিবর্তে রাখতে পারেন বেতের ঝুড়ি। বাজারে পাওয়া যাচ্ছে বেতের দেয়াল ঘড়ি, এতেও প্রকাশ পাবে আপনার ঘরের ভিন্নতা। আপনার ঘরের একটি রুম যদি বেতের আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো যায় এতে প্রকাশ পাবে আপনার নান্দনিক রুচি ও ঘরে থাকবে দেশীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া।
রিপন ঘোষ নিজের ব্যবসা সম্পর্কে বলেন, ২০১৩ সালে আমি অর্পা’স (Arpa’s) পেজের মাধ্যমে বেতের আসবাব অনলাইনে অর্ডার নিয়ে সারাদেশে ডেলিভারি দিতাম। তখন থেকেই আমরা ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদা দেখতাম৷ কারণ সময়ের আবর্তে দেশের মানুষের রুচিবোধের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ এখন ইকো-ফ্রেন্ডলি আসবাবপত্রের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এছাড়া গতানুগতিক ফার্নিচারের বদলে মানুষ শৈল্পিক ফার্নিচারের প্রতি ঝুঁকছেন। ফলে দিনকে দিন বেতের ফার্নিচারের প্রচুর চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া বেতের ফার্নিচার ওজনে হালকা কিন্তু টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী। ফলে তা সহজেই স্থানান্তরযোগ্য। এ কারণে শহুরে ব্যক্তিদের মধ্যে বেতের ফার্নিচারের চাহিদা বেড়েছে অনেক। দেশের মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন দূতাবাস ও প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিদের মধ্যেও বাংলাদেশের বেতের ফার্নিচারের অনেক চাহিদা রয়েছে। সর্বোপরি অন্যান্য যেকোনো ফার্নিচার থেকে বেতের ফার্নিচার তুলনামূলক সস্তা কিন্তু মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে অনেক চাহিদা তৈরি হয়েছে।
বর্তমান নগর সভ্যতায় আমাদের প্রতিনিয়তই বাসা পাল্টানোর প্রয়োজন হয়। বেতের ফার্নিচার তুলনামূলক হালকা হওয়ায় তা সহজেই স্থানান্তরযোগ্য। এছাড়া অন্য যেকোনো ফার্নিচারের চেয়ে বেতের ফার্নিচারের দাম তুলনামূলক কম। একই সাথে শৈল্পিক ঘর সাজানোর আসবাব হিসেবে বেতের ফার্নিচারের কোনো তুলনাই হয় না। বেত একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বেত উৎপন্ন হয়। তবে দেশে বেতের উৎসস্থল ধীরে ধীরে কমতে থাকায় ইন্দোনেশিয়া ও মায়ানমার থেকেও উন্নতমানের বেত আমদানি করা হয়। বর্তমানে বেতের ফার্নিচার তৈরির আগে বেতকে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। ফলে ভবিষ্যতে ঘুণপোকা ধরা বা অন্য কোনো পোকায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। ফলে বেতের ফার্নিচার হয় অনেক বেশি টেকসই ও মজবুত।
উল্লেখ্য, ভালো ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকেই বেতের ফার্নিচার কেনা উচিত। নাহলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় বেতকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করেন না । তাদের কাছ থেকে শতভাগ দূরে থাকা উচিত।
• কোথায় পাবেন :
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেই বেতের আসবাবপত্র পাওয়া যায় তবে মানের দিক বিচার করতে গেলে সবাই এগিয়ে নেই। অনলাইনে বিভিন্ন পেইজে বেতের জিনিস পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে বেছে নিতে পারেন অর্পা’স (Arpa’s)। তারা সারাদেশে সাবধানতা অবলম্বন করে বেতের আসবাবপত্র হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকে।
• বেতের আসবাবের যত্ন :
ফার্নিচারের যত্ন নেয়া অনেক সহজ। বেতের ফার্নিচার প্রধান শত্রু ধুলো। দীর্ঘদিন ধুলো জমা হলে বেতের রঙ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার শুকনো সুতি কাপড় দিয়ে মুছে নিলে ভালো হয়। এতে করে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেত ও বার্নিশ দুটোই ভালোই থাকে। ক্রমাগত বৃষ্টিতে বা পানিতে ভেজার সম্ভাবনা রয়েছে এমন স্থানে বেতের ফার্নিচার না রাখাই ভালো।