Skip to content

৬ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২৩শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বেনামী চিঠি, নারীর কঙ্কাল ও মানবতা

আজকাল নারী নির্যাতনের মাত্রা চরমতম হারে বেড়েছে। তবে এই হার বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর বিভৎসতাও! নারীকে কতটা কদর্য, বিকৃত, বিভৎসভাবে নির্যাতন- হত্যা- গুম করা যায়, তার সবটাই চলছে এখন। তবে নারীর প্রতি এত আক্রোশ উগ্রে দেওয়ার কারণ কী? নারী যে কোনোকালে এ সমাজের আদরণীয় ছিল না, তা মানুষ মাত্রইজানে। সে পুরুষ হোক বা নারী। তবে হ্যাঁ, এক শ্রেণির মানুষ অস্বীকার করতেই পারে। সেখানে কপটতা, ভণ্ডামি, শঠতাযুক্ত।

কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চায় দখল, কর্তৃত্ব, শাসন- শোষণ। যার ফলে নারী মাত্রই নিষ্পেষিত-শোষিত। কিন্তু কালের অববাহিকায় সমাজে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়৷ তবে এ সমাজে নারীর জন্য কোনোই পরিবর্তন সূচিত হয়নি। মহাভারতের যুগে নারী যেমন ক্রীড়ানক পুতুল ছিল, আজও তাই! শুধু পাল্টেছে এর করণ-কৌশলের। তবে কি সত্যি নারীর মুক্তি আর সম্ভব নয়!

নিত্যদিনের পত্র-পত্রিকা খুলতেই চোখ আটকে যায় নারী নিপীড়নের কোনো এক করুণতম দৃশ্য! কখনো নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে পিতা- মাতা- স্বামী- শ্বশুর- শাশুড়ি বা আত্মীয়-পরিজনদের দ্বারা। আবার কখনো বা ঘরের বাইরে ওঁৎপেতে থাকা হায়েনাদের দ্বারা। নারী আজও অস্পৃশ্য। ঘরে- বাইরে। নারীর মুক্তি মেলা যেন সত্যি আধুনিক যুগে এসেও দুরূহ। দ্রৌপদী, সীতার যুগ পার হয়ে এসেছে কিন্তু এ সমাজে রয়ে গেছে তাদের করুণ আর্তি। তাইতো আজও ঘরে- বাইরে শোষিত- বঞ্চিত এ যুগের সীতারা! যারা শত- সহস্র পরীক্ষা দিয়েও উতরাতে পারে না জীবনের খাতায়। কিন্তু সব হিসেব- নিকেশ চুকিয়ে দিয়েও নারীরা আপন জগৎ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে! বলা চলে প্রতি পদে প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল টপকাতে হচ্ছে। কেউবা সেই পরীক্ষায় কিঞ্চিৎ সফল কেউবা পুরোপুরি ব্যর্থ! আর এই ব্যর্থতার গ্লানিতে কেউ ডুব দিচ্ছে কেউবা সমাজকে পিঠ দেখাচ্ছে। তবে নারীর জন্য আগলে রাখা সুন্দর- সুগঠিত – সুস্থ সমাজ আজও কল্পনাতীত!

এক একটি ঘটনা মনকে বিষাদে ডুবিয়ে দেয়। তৈরি করে অস্তিত্বের সংকট! এ সমাজে নারী যদি প্রতি পদে ঠোকর খেতে থাকে তবে সুস্থ জীবনের আশা কোথায়! শুধু তাই নয় রয়েছে আইন- আলাদতের যথার্থতার ঘাটতি। নির্যাতন – নিপীড়নের শিকার নারীর প্রতি ন্যায়বিচারের দ্রুততা নিয়েও প্রশ্ন। যদিও কারো কারো ন্যায়বিচার প্রাপ্তি ঘটছে সেখানেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। ফলে অপরাধীদের ডাল- পালা গজিয়ে উঠতে এটি আরও সহায়ক হচ্ছে!

প্রসঙ্গক্রমে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ঘটনা তুলে ধরা যাক, পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের লামিয়া আক্তার (১৮) নামের এক কলেজছাত্রী ৪ মাস আগে নিখোঁজ হন। গত রোববার রাতে তার ঘরের সামনের সিঁড়িতে একটি বেনামি চিঠি পাওয়া যায়। এর সূত্র ধরে গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের মোজাহার মোল্লার বাড়ির পাশের জমি খুঁড়ে একটি কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ।

নিখোঁজ লামিয়া আক্তার চিথলিয়া গ্রামের নজরুল ইসলামের মেয়ে। এবং স্থানীয় সরকারি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। কঙ্কালটি তাঁর কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পুলিশ ও ওই কলেজছাত্রীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, লামিয়া আক্তারের সঙ্গে একই গ্রামের মো. তরিকুল ইসলামের (২২) প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গত বছরের ৩০ মে বিয়ের দাবিতে তরিকুল ইসলামের বাড়িতে অবস্থান নেন লামিয়া। এরপর স্থানীয় লোকজনের মধ্যস্থতায় তাদের বিয়ে হয়। তবে তরিকুলের মা-বাবা এই বিয়ে মেনে না নেওয়ায় লামিয়া বাবার বাড়িতে চলে আসেন।

গত ৭ ডিসেম্বর নিখোঁজ লামিয়া আক্তারের মা রাজিয়া বেগম স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিশ্চিত হন, ঘটনার দিন রাতে তরিকুল ও লামিয়া একসঙ্গে ছিলেন। এরপর ২৫ ডিসেম্বর তরিকুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে সাতজনের নাম উল্লেখসহ নয়জনের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় অপহরণের মামলা করেন রাজিয়া বেগম।

ঘটনার চার মাস পর গত রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে লামিয়ার ঘরের চালে ও বেড়ায় ঢিল ছুড়ে মারা হয়। এতে তার পরিবারের লোকজন ভয় পেয়ে এক আত্মীয়কে ডাকেন। তিনি এসে ঘরে ঢোকার সময় সিঁড়ির ওপর মাটির চাকা দিয়ে চাপা দেওয়া কাগজ পান। ওই কাগজে লেখা ছিল, ‘তোমাদের মেয়ের লাশ মোজাহার মোল্লার বাড়ির পশ্চিম পাশে বালুর মাঠের মধ্যে রাখা আছে।’ রাতেই লামিয়ার পরিবার পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পাহারা বসায়। পরবর্তীকালে সোমবার সকালে বালুর মাঠ খনন করে একটি কঙ্কাল পাওয়া যায়।

কঙ্কালটি লামিয়ার বলে দাবি করেন তাঁর মা রাজিয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘তরিকুল ইসলাম আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ বালুর মধ্যে চাপা দিয়ে রাখেন। বালুর মধ্যে পাওয়া কঙ্কাল আমার মেয়ের।’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই ঘটনায় কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত. প্রেম, দ্বিতীয়ত. প্রেমে অস্বীকৃতি, তৃতীয়ত. মধ্যস্ততায় বিয়ে, চতুর্থত. মৃত্যু অর্থাৎ হত্যা- গুম।

ঘটনাগুলো খালি চোখে দেখলেও একজন সুশীল মানুষ সহজেই বুঝবেন একটি ঘটনা আরেকটির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজের মানুষ আজও গছিয়ে দিতে পারলেই ভাবেন সব ঠিক হবে। এখানেও কিছু উদাহরণের প্রয়োজন, যেমন ধরুন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমস্যা – সংকট, সেখানে সাধারণ মানুষের সরাসরি পরামর্শ বাচ্চা নিলেই সংসার ঠিক হবে, আবার কোনো মানুষ একটু উদাসীন সেখানে তাকে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করা হয়। কেউবা মানসিক সংকটে ভুগছেন তাকেও বিয়ে- সংসারের পরামর্শ দেন আপামর জনগণ।

এমন নানারকম উদাহরণ টানা যাবে। সে যাইহোক এই নারীর প্রেম- প্রেমিকের বাড়িতে অনশন- বিয়ে সবটাই নাটকীয়। জোর- জবরদস্তি করে আর যাইহোক মনের বাঁধন পাওয়া ভার! কিন্তু এক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। আবার বয়সের সীমানায় বাস্তব জ্ঞানের অপ্রতুলতা দুজনেরই। কারণ আজকাল যেহেতু বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মেয়েদের ১৮, ছেলেদের ২১ বছর বিবাহের বয়স। তাই এই বয়স যে সত্যি এটাও প্রশ্নবিদ্ধ। তবে সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে কথা হলো নারী নির্যাতন!

কতটা বিভৎস মানসিকতা হলে একজন নারীকে ভালোবাসার ছলনায় আবদ্ধ করা, প্রেম – বিয়ের পর হত্যা করা যেতে পারে! আজকাল এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। নির্বিকার সমাজ তবু আজ নিশ্চুপ। সমাজের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না এ সমাজের স্খলন – পতন- নির্বিকার চিত্র! আজকাল মানুষের মধ্যে হারিয়ে গেছে মানবিকতা- মনুষ্যত্ব- বিবেক। যার পরনায় ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত – অপ্রীতিকর পরিস্থিতির। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী বিকচ্ছে আজও। নারীর নিজের জীবনের মূল্যায়ন নেই। বোধ নেই। যে বোধ তাকে মূল্যায়িত করবে সেই বোধের অভাবে আজ নারীরা বেশি নির্যাতিত। যুগে যুগে পুরুষের অত্যচার শিরোধার্য ভেবে আসা মানসিকতাকে বুকে লালন করে নারীরা পথ চলেছে। সেই পথ আজও অমলিন!

নারীদের মনে রাখা প্রয়োজন জীবনের মূল্য অধিক৷ ফলে যেখানে সম্মান-শ্রদ্ধার লেশমাত্র অনুপস্থিত, সেখান থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসা। যাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে না হয়। নাহলে কোনো একদিন নিজেও পত্রিকার শিরোনাম হয়ে ফিরে আসতেও হতে পারে! নারীকে বুঝতে হবে আর সে অনুযায়ী পা ফেলতে হবে। যদি বোধের ঘাটতি দেখা দেয় তবে হায়েনারা গিলে ফেলতে কাল ক্ষেপণ করবে না। কারণ এ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাই এরূপ! ফলে পায়ে পায়ে ঘোরা নির্যাতন-নিপীড়ন-মৃত্যুকে রুখতে নারীকেই সচেতন হতে হবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ