যা যেমন তাকে তেমনই বলতেন ইসমত চুঘতাই
উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসে ইসমত চুঘতাইয়ের নামটি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বহুদিন। উত্তরপ্রদেশের ছোট একটি শহর বদায়ুন – সেখানেই জন্মেছিলেন এই অসামান্য লেখিকা। বিরাট বড় পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ এই সদস্য নারীবাদকে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। ১৯১১ সালে বদায়ুনে জন্ম নেয়া লেখিকা নারীর মনের জটিলতাকে খুব ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছিলেন তার লেখায়। নিজ সময়ের নারীদের বিভিন্ন রূপকে বারবার তিনি লেখায় তুলে এনেছেন। উর্দু কল্পসাহিত্যের জগতে ইসমত চুঘতাইকে প্রধান বলেই বিবেচনা করা হয়।
চুঘতাইয়ের বাবা মির্জা কাশেম বেগ একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। বাবার কাজের জন্যেই পরিবারকে কখনো আগ্রা, যোধ অথবা আলিগড়ে থাকতে হয়েছে। নয় ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট চুঘতাই সুযোগ পেয়েছেন ভাইদের সাথে সময় কাটানোর। একবার এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, "আমার মনে হয়না পুরুষ কিংবা নারী দুজনের মধ্যে ফারাক খুঁজে নিতে হবে। একদম বাচ্চাকাল থেকেই আমি তাই করার চেষ্টা করতাম যা আমার ভাইয়েরা করতেন।"
সাহিত্যের জগতে আসার আগে চুঘতাইয়ের জীবনে সবসময় ছিলো নিজের প্রতি অগাধ আস্থার ছাপ। নিজের আত্মজীবনীতেই একবার লিখেছিলেন, "১২ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বাড়িতেই পড়াশোনা করেছি, তাও মূলত কোরান পড়তাম। আমার ভাইয়েরা কিন্তু ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। ছেলে আর মেয়েকে আলাদা করে দেখাটা আমার ভালো লাগত না, তাই ঝগড়া করতাম খুব।"
এই ঝগড়াই ছিলো ইসমতের শেকল ভাঙার গান। হয়তো ছেলেমানুষের মতোই জেদ। তবে সেটা বয়সের অনভিজ্ঞতার দরুণ। গোঁড়া মুসলিম পরিবার মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে অত ভাবতেন না। বাড়ির অন্য মেয়েদের এমনিতেও বিয়ে হয়ে গেছে। আর ভাইদের সাথে বড় হওয়ায় মেয়েলি ধাঁচ তার ঠিক ছিলোনা। ম্যাট্রিকের পর তো আর লেখাপড়ার দরকার নেই। কিন্তু ইসমত জানালেন তাকে পড়তে না দিলে মিশনারি স্কুলে চলে যাবে। এই ভয়ে পরিবার ঠিকই তাকে আলীগড়ে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেয়। এখানেই তিনি বিএ এবং বিএড সম্পন্ন করবেন।
চুঘতাইকে সাহিত্যজগতে আপা বলেই জানতেন সবাই। এই সাহিত্যের সাথে কিভাবে পরিচয় ঘটলো তা সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। খুব ছোটবেলায় তিনি মানুষের মুখেই গল্প শুনতেন বেশি। পুরুষ ও নারীদের এই গল্পগুলো তাকে অনেক প্রভাবিত করেছে।
কৈশোরেই লেখা শুরু করেন। এছাড়া চোখের সামনেই বড়ভাই মির্জা আজিম বেগ চুঘতাইকে দেখেছেন। বড়ভাই নিজেও প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক। যিনি কিনা লেখায় খুব সূক্ষ্ম হাস্যরস টেনে আনতে পারতেন। তারপর নাট্যকার বার্নার্ড শ এর মাঝেই মুগ্ধতা খুঁজে পান। বন্ধুবান্ধব তা নিয়ে বেশ হাস্যরস করতেন। তবে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্কুল (এখন উইমেন কলেজ) এ পড়ার সময় তিনি পাশ্চাত্য সাহিত্যের সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে শুরু করেন। সাহিত্য জীবন চুঘতাইয়ের শুরু হয় ১৯৩৮ সালে। ততদিনে প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দিয়েছেন। এমনকি বোরখা পরাও বাদ দিয়েছেন। সাকি ম্যাগাজিনি ফাসাদি নামে একটি গল্প জমা দেন। গল্পের বুননের মুন্সিয়ানা দেখে অনেকেই তখন কানাঘুষো শুরু করে দেয়। আসলে গল্পটি তার বড় ভাই আজিম বেগ চুঘতাই লিখেছেন বলেই সকলের বিশ্বাস।
এমন সময় এক ধর্মীয় গুরু উইমেন স্কুলকে এক বেশ্যাখানার সাথে তুলনা করে মন্তব্য করেন। চুঘতাই চুপ থাকতে পারেননি। তিনি আলীগড় গ্যাজেটে কড়া ভাষায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে প্রগতিশীল শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামার আহ্বান জানান। এই লেখায় কাজ হয়েছিলো। অনেকেই সাড়া দিয়েছিলো তার ডাকে।
১৯৩০ এ কিছু প্রগতিশীল লেখক মিলে প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশন গঠন করে। সমাজের গোঁড়ামি এবং অন্যায় নিয়েই তারা লিখতেন। এখানেই চুঘতাইয়ের সাথে রাশিদ জাহানের দেখা হয়। এই রাশিদ জাহান একজন প্রখ্যাত লেখক ও পরিচালক। রাশিদের হাত ধরেই উর্দু নারী সাহিত্য এক নতুন বাক নিবে। এই সুযোগ চুঘতাই বুঝতে পেরেছিলেন। নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়েই তিনি মানবাধিকার এবং সমতার কথা জানাবেন।
১৯৪১ সালে তার প্রথম উপন্যাসিকা জিদ্দি বেশ বিতর্কিত হয়েছিলো। তবে তিনি তা পাত্তা দেননি। এমনকি উর্দু সাহিত্য পত্রিকা ‘আদাব-ই-লতিফ’-এ প্রকাশিত হয় তার গল্প ‘লিহাফ’। ধনী জমিদারের স্ত্রীর সঙ্গে কাজের মেয়ের সমকামী সম্পর্ক ছিল এ গল্পের মূল উপজীব্য। এই গল্পের জন্যে ইংরেজ সরকার তার উপর অশ্লীলতার অভিযোগ আনে। ন্সাহোর আদালতে একটি মামলাও হয়। ইসমত একবারো ক্ষমা চাননি। দুবছর পর তিনি ঠিকই মামলাটি জিতে যান।
একসময় হিন্দি ছবির পরিচালক শাহিদ লফিত তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তবে ইসমাত জানান যে দুজনের মনের মিল নাও হতে পারে। তাও লতিফ হাল ছাড়েননি। দুজনে মিলে গড়ে তোলেন এক অপূর্ব জগত। "জিদ্দি" "আরজু" "তেরহি লারকি" এর মতো চলচ্চিত্রগুলো দিয়ে দর্শকের মন দ্রুতই জয় করে নেন। দেবানন্দের মতো অভিনেতাকেও তুলে আনেন তিনি।
তবে চুঘতাইয়ের বৈশিষ্ট্য তার লেখায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে তিনি একটি সরল ছকে বসান নি – যেখানে পুরুষ অত্যাচার করে আর নারী তা সহ্য করে। বরং আরো ক্রুর ও বক্রভাবে তিনি এঁকে গেছেন সেই গল্পগুলো। আঁকাড়া বাস্তব রচনায় তার এলেম প্রশংসাযোগ্য। তখন উর্দু সাহিত্যিক রাশিদ জাহানই তার পূর্বসূরি নারী লেখিকা। তবে চুঘতাই আরো জটিল। তার লেখা নারীবাদী প্রেক্ষিতকে একেবারেই এলোমেলো করে দিবে। চেনা নারীবাদী ছাঁচে তার গল্পগুলো কোনোভাবেই কাজ করবেনা। বামপন্থী শ্রেণীর ভিত্তিতেও একে বিবেচনা করা অসম্ভব।
চুঘতাই ছিলেন দেশীয় মুসলিম সমাজে প্রথম বিএড ডিগ্রিসম্পন্ন মহিলা গ্র্যাজুয়েট। মুসলিম সমাজে এমন বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই অকল্পনীয়। শিক্ষার জন্যই বলেছিলেন, 'বোরখা পরে সুযোগ পেলে বোরখা পরেই সুযোগ নেব।" একে কি কোনোভাবেই প্রগতিশীলতা বলা যায়না? তবে কোন ছকে ফেলবেন?
মৃত্যুর পরে তাকে দাহ করা হয়েছিলো। মৃত্যুর পর নিজেকে কফিনে রাখতে রাজি হননি। নিজেকে এক প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবেই বারবার প্রতিষ্ঠা করেছেন চুঘতাই। আর নিজের নামটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন উর্দু সাহিত্যের অগ্রগণ্য সাহিত্যিক হিসেবে।