Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী 

সময়টা যখন নারীর ঘরের চার দেয়ালে বন্দি থাকার, সেই সময়ে নারীর চলাচল স্বাভাবিক করা এবং নারীরাও যে পারে, তা প্রমাণ করার জন্য অনেক মহীয়সী নারী এগিয়ে এসেছেন। সেই রক্ষণশীল সমাজেরই একজন নারী, যিনি বাংলার নারীদের দেখিয়েছেন আধুনিকতার পথ, মেয়েদের পোশাকে পরিবর্তন এনে তৈরি করেছেন আধুনিক এবং আরামদায়ক শাড়ি পরার কৌশল। ছোটদের জন্যও তিনি সমৃদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকেন। একের পর এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন এবং অন্ধকার থেকে আলোর মশাল হাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া একজন নারী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। তাঁর দেখানো আধুনিকতার ছোঁয়াতেই আজও  আমরা আলোকিত হই।

যশোর জেলার নরেন্দ্রপুর গ্রামে ১৮৫০ সালের ২৬ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। বাবা অভয়চরণ মুখোপাধ্যায় এবং মা নিস্তারিণী দেবী।মাত্র আট বছর বয়সে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজপুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। 

ঠাকুরবাড়ির পুরনো ‘দাসী’দের বধূ নির্বাচনে যশোর পাঠানোর প্রথাটি জ্ঞানদানন্দিনীর ক্ষেত্রেও বহাল ছিল। বিয়ের সময় সত্যেন্দ্রনাথের বয়স ছিল সতেরো বছর। পাশ্চাত্য শিক্ষার সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের এরই মধ্যে পরিচয় হয়ে গিয়েছে এবং নতুন রকমের জীবনযাপন পদ্ধতির ঝলকানি দেয় তাঁর চোখে। 

অভিজাত ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূর তকমা চাপিয়ে দেওয়া হয় আট বছরের শিশুর ওপর এবং শৈশবেই পরতে হয় কঠোর পর্দার মাঝে। 

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন বিষয়ে রক্ষণশীল হলেও স্ত্রী-শিক্ষার ব্যাপারে খুবই উদারমনা ছিলেন। তাঁর প্রথম কন্যা সৌদামিনী দেবী বেথুন স্কুলের একদম প্রথম দিকের ছাত্রী। বাড়ির বৌদের স্কুলে না পাঠালেও তাদের শিক্ষার আয়োজন চলত বাড়িতে। মেয়েদের শিক্ষার জন্য বাড়িতে নিয়মিত বৈষ্ণব এবং ইংরেজ মহিলারা আসতেন। 

 

মহর্ষির সেজ ছেলে হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়েদের পড়ানোর ব্যাপারে বেশ উৎসাহ ছিল এবং বাড়ির মেয়েরা মাথায় এক হাত ঘোমটা দিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে পড়তে বসতেন। মহর্ষি নিজের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজে নবীন আচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশিকে নিযুক্ত করেন মেয়েদের গৃহশিক্ষক হিসেবে।অনাত্মীয় পুরুষের অন্দরমহলে প্রবেশ শুধু মেয়েদের শিক্ষার জন্য সেই সময়ে সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সবার তত্ত্বাবধানে জ্ঞানদানন্দিনীর পড়াশোনা মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য পর্যন্ত এগোল।

 

প্রথম বারের মতো ব্রিটিশদের সাথে ভারতীয়রাও সর্বভারতীয় স্তরে আইসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।১৮৬২ সালে ভারতবাসী যুগান্তকারী খবর পেল যে, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি প্রবেশনারি ট্রেনিংয়ের জন্য যখন ইংল্যান্ড যান, তখন স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকেও সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু বাবা দেবেন্দ্রনাথ সেটি মানলেন না।

 

১৮৬৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন প্রথম ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড থেকে ফিরলেন, তাঁর কর্মস্থল ঠিক হয় মুম্বাই।জ্ঞানদানন্দিনী স্বামীর সাথে মুম্বাইতে গিয়ে বসবাস শুরু করলেন। 

 

রক্ষণশীল বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে পা রাখলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। কিন্তু বাইরে যাবেন কোন পোশাক পরে? ঘরের কোণে যাদের জীবন কাটবে, যাদের সাজসজ্জা নিয়ে মাথা ঘামানো অর্থহীন।কোনোক্রমে একটি শাড়ি পেঁচিয়ে রাখতেন, যা বাইরে বের হওয়ার উপযুক্ত নয়।অনেক ভাবনা-চিন্তার পর ফরাসি দোকানে অর্ডার দিয়ে কিম্ভূতকিমাকার ওরিয়েন্টাল ড্রেস বানানো হলো, কিন্তু পোশাকটি যথেষ্ট অস্বস্তিকর। 

 

সেই সময়ে জ্ঞানদানন্দিনী ভেবেছিলেন, বাঙালি নারীর সর্বত্র স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণের জন্য একটি আদর্শ পোশাক দরকার। মুম্বাইয়ের পারশি পরিবারে গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী লক্ষ্য করলেন, তারা শাড়ির আঁচল ডান কাঁধের ওপরে পরে।তিনি পদ্ধতিটির সামান্য পরিবর্তন করে আঁচল কাঁধের ওপর দিয়ে শাড়ি পরার অভিনব কৌশল তৈরি করেন। জ্ঞানদানন্দিনীর পর কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা মহারানি সুনীতি দেবী শাড়িতে আরেক মাত্রা যোগ করেন। সামনের দিকে দুটি ভাঁজ না দিয়ে তিনি বাড়তি কাপড়টুকু কুঁচি দিয়ে পরার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ রীতিই এখনো পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘বামাবোধিনি পত্রিকা' নামে একটি ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপনও করেছেন, তাঁর মতো করে শাড়ি পরার প্রশিক্ষণ দিতে। কলকাতায় তাঁর অনুগত প্রথম দিককার ছাত্রীদের মধ্যে একজন বিহারী লাল গুপ্তা আইসিএসের স্ত্রী সৌদামিনী গুপ্তা।কলকাতার ব্রাহ্ম নারীদের মধ্যে তা দ্রুত জনপ্রিয়তা পেতে থাকল ‘ব্রাহ্মিকা শাড়ি'নামে।এটি পরার ধরন পরিবর্তিত হয়ে ‘বোম্বাই দস্তুর' এবং শেষে ‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি'নাম হয়।

কলকাতায় থাকাকালে বাংলায় পড়াশোনা চললেও ইংরেজি একেবারেই জানতেন না জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। সত্যেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে ইংরেজি, মারাঠি,গুজরাটি,হিন্দি ভাষায় তিনি সাবলীল হয়ে উঠেন। 

 

১৮৬৬ সালে ভাইসরয় লর্ড লরেন্সের দেওয়া  ভোজসভায় স্বামীর সাথে যোগ দিয়ে কলকাতায় জ্ঞানদানন্দিনী উচ্চবর্ণের পরিবারের রীতি-নীতি ভাংলেন। পাথুরিঘাটার প্রসন্ন কুমার ঠাকুর সেখানকার আমন্ত্রিতদের মধ্যে একজন ছিলেন এবং জ্ঞানদানন্দিনীর দৃঢ়তায় তিনি গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হলেন এবং ভাইসরয়-আবাস ত্যাগ করে চলে যান।

 

আহমেদাবাদ, সিন্ধুদেশ,কানাডা,মহারাষ্ট্র প্রভৃতি স্থান ঘুরে দুই বছর পর আবার কলকাতায় ফিরলেন জ্ঞানদানন্দিনী। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে অপরূপ বেশবাসে, পায়ে জুতা ও বিলেতি মোজা পরিহিতা যে নারী ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করেন,এর সাথে দুই বছর আগের মেয়েটির আকাশ-পাতাল তফাৎ। বাড়ির অধিকাংশ নারী জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গ বর্জন করলেও তাঁর শাড়ি পরার অভিনব ভঙ্গিমাটি কেউই উপেক্ষা করতে পারেনি।তাঁর শ্বশুর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাবকে উদারভাবে মেনে নিতে পারেননি, ফলে ঠাকুর পরিবারে এক ধরনের মতভেদ দেখা যায় বলে শোনা যায়। 

 

জ্ঞানদানন্দিনী নিজের মতো করে থাকতে জোড়াসাঁকো ছেড়ে কাছেই পার্ক স্ট্রিটে চলে যান।এত নৈকট্য সত্ত্বেও তাঁদের দুজনের মধ্যে কখনোই আর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।এ সময় তাঁর ছোট দেবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর স্নেহের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে তিনি নিয়মিত আসতেন। ১৮৬৯ সালে জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর স্বামীর সাথে মুম্বাই ফিরে যান। সেই বছরই তাঁর প্রথম সন্তানের জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে তাকে হারান তিনি। ১৮৭২ সালে পুত্র সুরেন্দ্রনাথের জন্মের সময় এই দম্পতি ফের এক সঙ্গে থাকতেন। পরের বছর কন্যা ইন্দিরা দেবী বিজয়পুরে জন্মগ্রহণ করেন। সে-সময় ভারতীয় অভিজাত পরিবারগুলোতে শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের নার্স কিংবা গভর্নেসদের তত্ত্বাবধানে বাচ্চা রাখার একটি সাধারণ রীতি ছিল। ১৮৭৬ সালে পরিবার থেকে দূর প্রবাসে সিন্ধু প্রদেশের হায়দ্রাবাদে তাঁর তৃতীয় ছেলে কবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়।

 

১৮৭৭ সালে জ্ঞানদানন্দিনী গর্ভবতী অবস্থায় তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। কোনো পুরুষসঙ্গবিহীন একা ভারতীয় নারীর সাগর পাড়ি দেওয়া সেই সময়ে শোনা যেত না।তাঁর এই সাহসিকতা সামাজিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে।১৮৭৮ সালের অক্টোবরে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছুটিতে ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ইংল্যান্ডে যান। রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর সন্তানদের দ্রুত সখ্য গড়ে ওঠে। সত্যেন্দ্রনাথের ছুটি শেষে সুরাটে বদলী হয়ে যান এবং জ্ঞানদানন্দিনী সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। 

 

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী পশ্চিমা সংস্কৃতির অনেক কিছুই গ্রহণ করেছিলেন,কিন্তু তিনি সাহেবিয়ানা পছন্দ করতেন না।আদর্শ জীবনযাপনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই তিনি গ্রহণ করেছেন এবং সারা জীবন ইংরেজদের অনুগ্রহ ভিক্ষা করে কাটিয়ে দেওয়াকে অপছন্দ করতেন। তিনি জন্মদিন পালন,বিকেলে বেড়াতে বেড়ানোর দৃষ্টি স্থাপন করেছেন। যা বর্তমান সময়ে স্বাভাবিক বিষয় হলেও দেড় শ বছরআগে স্বাভাবিক ছিল না। 

 

জ্ঞানদানন্দিনী দেবী শিশুদের ছবি আঁকায় উৎসাহ দিতে লিথো প্রেস বসিয়েছিলেন,এর ব্যয় তিনি নিজে বহন করতেন।ভারতীতে কিন্ডারগার্টেন ও স্ত্রী-শিক্ষা নামে দুটি প্রবন্ধ ছাপা হয়।'ভাউ সাহেবের খবর' মারাঠি রচনার বঙ্গানুবাদ করেন তিনি। এ-ছাড়া,তিনি 'ইংরেজ নিন্দা ও স্বদেশ অনুরাগ' নামের একটি প্রবন্ধ লিখেছেন এবং 'সাত ভাই চম্পা',ও 'টাক ডুমাডুম' নামে দুটি রূপকথার নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। 

 

জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সহজভাবে সব কিছু নিজের আয়ত্তে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করার বিষয়েও সাহায্য করেন। তাঁরই পরিপ্রেক্ষিতে ঠাকুরবাড়িতে একের পর এক মঞ্চস্থ হতে থাকে 'বাল্মিকী প্রতিভা', 'কালমৃগয়া', 'রাজা ও রাণী', 'মায়ার খেলা', 'বিসর্জন' ইত্যাদি। 'রাজা ও রাণী' নাটকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা বিক্রমের ভূমিকায় এবং জ্ঞানদানন্দিনী দেবী রাণী সুমিত্রার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ অভিনয়কে কেন্দ্র করে তাঁর নামে বঙ্গবাসী পত্রিকায় সেই সময় যথেষ্ট কটাক্ষ করা হয়েছিল। 
 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ