পৃথিবীর প্রথম নারী আকাশযোদ্ধা সাবিহা গকসেন
পাইলট হতে হলে নারীকে পার হতে হয় বহু বাধাবিঘ্ন। তাহলে ভেবে দেখুন, ইতিহাসের প্রথম নারী যোদ্ধা পাইলটের জীবনটা কেমন ছিল? হয়তো আধুনিক যুগে ব্যাপারটা হজম করতে অসুবিধা হবে। কিন্তু যে দেশের এক নারী ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন, সেই প্রীতিলতার দেশের মানুষ তিনি, তাতে অবাক হবেন কেন? আকাশপথের যোদ্ধা নারীর ইতিহাস সাবিহা গকসেনের নাম উল্লেখ করা অকল্পনীয় ব্যাপার। আকাশবালিকা উপাধি পাওয়াটা সম্ভবত সাবিহা গকসেনেরই মানায়। মাত্র ২৩ বছর বয়সে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারী যোদ্ধা পাইলট হওয়ার সফরটা শুধু এই সাফল্যেই থেমে ছিল না। বরং আরো বিপৎসংকুল এবং ভয়াবহ এক পরিণতির দিকেই ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। কিন্তু সে তো ঠিক গৌরবের। মজার ব্যাপার হলো, তাঁর নামের সাথে গকসেন উপাধিটুকু যোগ করা হয় ১৯৩৫ সালে। যার মানে 'আকাশের সাথে মৈত্রী'।
সাবিহার জন্ম ২২ মার্চ ১৯১৩ সালে। বসনিয়াক বংশোদ্ভূত বাবা মুস্তাফা ইজ্জত বে এবং মা হারিয়ে হানিমের ঘরে এক কিংবদন্তী জন্ম হয় সবার অলক্ষ্যে। তবে খুব অল্প বয়সেই তাঁকে অনাথ হতে হয়। মাত্র ১২ বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯২৫ সালে সাবিহা আতাতুর্কের সাথে কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করেন। ইচ্ছে, বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সাহায্য প্রার্থনা করবেন। কামাল আতাতুর্ক এই সাহসী মেয়ের কথায় মুগ্ধ। দ্রুতই তিনি সাবিহাকে দত্তক নেন এবং কান্যাকা প্রেসিডেন্সিয়াল রেসিডেন্সে ঠাঁই গড়ে দেন। কামাল আতাতুর্কের দত্তক নেওয়া মোট ১৩ জন সন্তানের একজন সাবিহা গকসেন।
কামাল আতাতুর্ক আকাশপথে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আর তাঁর অধীনেই গ্লাইডার এবং প্যারাস্যুটারদের ক্রমাগত প্রশিক্ষণের মহড়া চলে। যেহেতু সাবিহা খুব কাছ থেকেই বিষয়গুলো লক্ষ্য করতেন, তাই আগ্রহ বাড়তেও বেশি সময় লাগেনি। আতাতুর্ক নিজেও সাবিহাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, 'মনে হয়? তুমিও স্কাইডাইভার হবে?' সাবিহা নির্দ্বিধায় উত্তর দেন, 'হ্যাঁ, আমি এখন প্রস্তুত।' এই কথায় আতাতুর্ক বিশেষ খুশি হন। তাঁরই নির্দেশে সাবিহা প্রথম নারী শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান।
১৯৩৫ সালে তুরস্কের আনকারাতে ১৯৩৫ সালে একটি ফ্লাইট স্কুল স্থাপিত হয়। সেখানকার গ্লাইডার শো দেখে আকাশপথে ওড়ার স্বপ্ন তাকে ছুঁয়ে বেড়ায়। সেখান থেকেই টার্কিশ সিভিল এভিয়েশন স্কুলে ভর্তি হওয়া। মূলত ১৯৩৫ সালে স্থাপিত টার্কিশ অ্যারোনটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অধিভুক্ত ছিল। মূলত, সেখানেই তিনি একজন গ্লাইডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। হওয়ার কথা ছিল স্কাইডাইভার, হলেন পাইলট। বুঝতে পেরেছিলেন, উড়তে পারলেই তাঁর বেশি আনন্দ হবে। একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশিক্ষণের জন্যে তাঁদের পাঠানো হয়। আটজনের এই দলে একমাত্র নারী সাবিহা। সমস্যা হলো, সে-সময়ে মিলিটারিতে নারীদের কোনোভাবেই নেওয়া হতো না। কিন্তু আতাতুর্কের নির্দেশে সাবিহাকে একটি বিশেষ পোশাক বানিয়ে দেওয়া হয়। সম্ভবত, কামাল আতাতুর্ক সাবিহার প্রতিভা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাঁর নির্দেশেই সাবিহা এস্কেসেইর মিলিটারি এয়ার স্কুলে ১৯৩৬ সালে ভর্তি হতে সক্ষম হন। ১১ মাসের প্রশিক্ষণে সাবিহা গ্লাইডিংয়ে আরো দক্ষ হয়ে ওঠেন। একই সময়ে ফাইটার এয়ারক্র্যাফট পরিচালনা এবং বোম্বার ব্যবহারে তিনি দক্ষ হয়ে ওঠেন।
১৯৩৮ সালেই সাবিহা বালকান স্টেটে প্লেন নিয়ে অভিযানে যান। তুরকুসুতে তিনি 'চিফ অব ট্রেইনার' পদবি লাভ করেন নিজ যোগ্যতাবলে। এই স্কুলেই আসলে সাবিহা ইতিহাস নির্মাণ করেন। সাবিহার বদৌলতে আরো অনেক নারী পাইলটের জন্ম হয়। জীবিতাবস্থাতেই সাবিহা যেন কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন। নিজের ক্যারিয়ারে সাবিহা মোট ৩২টি মিলিটারি অপারেশনে যোগ দেন। প্রতিটি অপারেশনেই তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সাবিহাকে ইতিহাসের প্রথম নারী যোদ্ধা পাইলট আখ্যা দেয়া হয়। এমনকি ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্সের প্রকাশিত 'ইতিহাসের সেরা ২০ বিমানযোদ্ধাদের' মধ্যে একমাত্র নারী হিসেবে সাবিহা গকসেনের নাম জ্বলজ্বল করছে।
ইতিহাসের গতি সব সময় ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে আগায় না। ২০০১ সালের ২২ মার্চ সাবিহা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পৃথিবী হয়তো কিছু কিংবদন্তীকে জীবিত রাখেন। দেখাতে চান, ইতিহাস কথা বলে। সাবিহাও তেমনই একজন। মিলিটারিতে নারীদের অংশগ্রহণের পথিকৃৎ হিসেবে সাবিহার নাম সব সময় ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। যেমনটা আতাতুর্ক বলেছিলেন, 'মানবজাতি পরিপূর্ণ হয় নারী ও পুরুষ মিলে। জনসংখ্যার একাংশের উন্নতিতে কি অন্য অর্ধেক অংশ কোনোভাবে উন্নত হতে পারবে? নয়তো অর্ধেক জনসংখ্যা মাটিতে আটকে থাকুক আর অর্ধেক আকাশপথে উড়ে বেড়ালে সমাধান মিলবে।' সেই সমাধানই কি সাবিহা দেখিয়ে গেছেন? আধুনিক সময় কী বলে? চোখ ফেরাই আকাশপথের অনন্যাদের দিকে।