Skip to content

১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেয়ার নির্দেশনা আদালতের

ধর্ষণ একটি ঘৃণ্যতম অপরাধ যা মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ধ্বংস করে দেয়। ধর্ষণের মতো অপরাধ কোনো জাতির জন্য একটি বড় কলঙ্ক। বাংলাদেশ আইনে ধর্ষণের কঠিনতম শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের এই বিচার ও শাস্তি কি সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে?  ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা পার হলে পুলিশ যেন মামলা না নেয় এমন নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। 

 

আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। অযথা আদালতের সময় নষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। এ কারণে পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর কোনো ধর্ষণের মামলা না নেয় সে আদেশও দেন।

রাজধানীর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার পাঁচ আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। তাদের একজন হলো আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ। বাকিরা হলো সাফাতের দুই বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম ও সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী। 

 

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে ওই দুই তরুণীকে নিয়ে আসা হয়। মদ খাওয়ানোর পর ওই দুই তরুণীকে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়। প্রথম দিকে মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে এ ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলে ওই বছরের ৬ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর বনানী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে ভুক্তভোগী এক ছাত্রী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। রহমত আলী ছাড়া বাকি সবাই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

 

গত বৃহস্পতিবার রায় দেওয়ার পর আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা পার হলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়’। 

রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, ডিএনএ পরীক্ষা এবং আলামত থেকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই, ধর্ষণের অভিযোগ আনা হলেও এটিকে ধর্ষণ বলা যাবে না। তা ছাড়া, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। এ জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেছেন আদালত। 

 

রায় পড়ার সময় বিচারক আরও বলেছিলেন ‘আপনারা বলছেন- এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। এ মামলাটির মেডিকেল রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ডাক্তাররা কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।’

 

পর্যবেক্ষণে বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার বলেন, ‘মামলার দুই ভুক্তভোগী আগে থেকেই সেক্সুয়াল (যৌন) কর্মে অভ্যস্ত। অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি।’

আদালতের এ নির্দেশনার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা। আদালতের এই রায়ে মামলা কলঙ্কিত হওয়ার কথা অনেকে তুলেছেন। ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো সময়সীমা আমাদের প্রচলিত আইনব্যবস্থায় বেঁধে দেওয়া নেই। সেক্ষেত্রে বিচারকের এ নির্দেশনা সম্পূর্ণ বেআইনি।

 

অপরাধ যাতে প্রমাণ করা যায়, সে বিষয়ের ওপর জোর না দিয়ে বিচারক ৭২ ঘণ্টার পরে মামলা না নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ধর্ষণের শিকার মানুষের বিচার পাওয়ার পথে কঠিন অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। এতে ধর্ষক বা ধর্ষকেরা ভুক্তভোগীকে ৭২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখতে পারলেই নিজেদের বিচারের আওতামুক্ত থাকা নিশ্চিত করে নিতে পারল। এছাড়াও সাধারণত ভিকটিম মানসিকভাবে স্থিতিশীল হতেও অনেক সময় ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে যেতে পারে। এই সুপারিশ ভিকটিমের জন্য ন্যায়বিচার পেতে সহায়ক হবে না। এমনিতে ভিকটিম ও পরিবার মামলা করতে ভয় পায়। সেখানে বাধানিষেধ জুড়ে দিলে কেউ এগিয়ে আসবে না। তাহলে এই ৭২ ঘন্টার নীতির যথার্থতা কতটুকু?

 

ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা পুরো দেশ ও জাতিকে চরম হতাশার মুখে ফেলে দিয়েছে।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ