Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আফগানিস্তানের নারী জাগরণের অগ্রদূত: রানী সোরাইয়া

বরাবরই আফগানিস্তান ছিল একটি ধর্মান্ধ দেশ। ইসলাম ধর্মকে ঘিরে হলেও নানা কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে চলতো আফগানিস্তানের জীবনযাত্রা। আর এই কুসংস্কার ও বৈষম্যের সবচেয়ে বড় শিকার ছিল সমাজের নারীরা। যুগ যুগ ধরে তারা কেবল পুরুষদের অধীনতায় বেড়ে উঠছিল। কেবল তাই নয়, তাদের নিজস্ব কোন স্বাধীনতা ছিলোনা এমনকি তারা বাইরেও যেতে পারতোনা। আর শিক্ষার সুযোগ তো অনেক দূরের কথা অনেক অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দেয়া হতো। আর পর্দাশীল পোশাক পরিধানে তাকে বাধ্য করা হতো। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এক নারীর পদচারণা ঘটে আফগানিস্তানে যিনি তৎকালীন সমাজে নারীর বৈষম্য রোধে ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগাধ কার্যক্রম প্রারম্ভ করেছিলেন। তিনি হলেন সোরাইয়া তারজি। পরিবর্তনের সুর নিয়ে সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য হাতে নিয়ে আফগানিস্তানের নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে অবতীর্ণ হন তিনি। 

 

সোরাইয়া তারজি ছিলেন আফগানিস্তানের আমির আমানুল্লাহ খানের স্ত্রী। রানী সোরাইয়া রাষ্ট্রের নারী অধিকার উন্নয়নে কাজ শুরু করলে স্বামী আমানুল্লাহও তাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেন। তারা উভয়েই ছিলেন তাঁর মতই বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী ও আধুনিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী। হিজাবী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরে এক সভায় নিজের হিজাব টেনে ছিঁড়ে ফেলার মতো দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন তিনি। আজ আমরা এই দুঃসাহসী নারী সম্পর্কে জানবো।

 

১৮৯৯ সালের ২৪ নভেম্বর সিরিয়ার দামাস্কাসে জন্ম সোরাইয়ার। তার বাবা ছিলেন সর্দার মাহমুদ বেগ তর্জি। তিনিও ছিলেন একজন সাহসী আফগান। সোরাইয়ার যখন জন্ম হয় তখন পরিবার সহ সিরিয়ায় নির্বাসনে ছিলেন তিনি। তৎকালীন আফগান আমির আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য মাহমুদকে নির্বাসনে যেতে হয়। ধর্ম নিরপেক্ষ, আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠায় আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন তিনি। আফগান সাংবাদিকতার জনকও বলা হয় মাহমুদকে। পরবর্তীতে ১৯০১ সালে আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পর মাহমুদকে আফগানিস্তানে সম্মানের সাথে ফিরিয়ে আনেন তৎকালীন আমির হাবিবুল্লা খান। আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয় মাহমুদকে। মাহমুদও লেগে পড়েন নতুন আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এসময় পশ্চিমা সংস্কৃতির সাহায্য নেন। পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সমাজ সংস্কারের কাজ শুরু করেন। মূলত এভাবেই সোরাইয়া আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন।

 

১৯১৯ সালের ২০ ফ্রেব্রয়ারি আমির হাবিবুল্লাহ খান নিহত হলে তাঁরই তৃতীয় পুত্র আমানুল্লাহ খান আফগানিস্তানের আমির পদে অধিষ্ঠিত হন। এর আগেই কিশোর অবস্থায় আমানুল্লাহর সাথে পারিবারিক ও নিজ সম্মতিতে সোরাইয়ার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। তাদের বয়সের পার্থক্য ছিল সাত বছর। আমানুল্লাহ আমিরের পদে অধিষ্ঠিত হলে সোরাইয়া তারজি হয়ে ওঠেন আফগানিস্তানের রানী। এর মাধ্যমে তারা দুজনেই নতুন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। 

 

সকল কাজে একে অপরের দোসর হয়ে উঠেছিলেন তারা। প্রশাসনিক কর্মসূচি, শিকার করা, মন্ত্রিসভার বৈঠক, যুদ্ধ, এমনকি বিদ্রোহী অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শন, সব কিছুতেই আমানাতুল্লার পাশে দেখা যেত সোরাইয়াকে। সোরাইয়াকে দেশের শিক্ষামন্ত্রীও নিযুক্ত করেন আমানাতুল্লা। আফগানিস্তানের যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কৃতি পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে থাকেন তারা। 

 

ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করেন আমানুল্লাহ। ১৯২১ সালে কাবুলে প্রথম মেয়েদের জন্য মাসতুরত প্রাথমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন সোরাইয়া। এরপরে তিনি আরও পাঁচটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং সেগুলো দেখভাল করেন। তিনি মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার্থে ইউরোপ ও তুরস্কে প্রেরণ করেন। আমানুল্লাহ তাঁর নিজ কন্যা মালিহাকে চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তোলেন। আমানাতুল্লাহই আফগানিস্তানের প্রথম আমির বা বাদশাহ যিনি এক বিবাহ করেছিলেন এবং এক স্ত্রীতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের পছন্দের স্বাধীনতা, উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সমান অধিকার এবং নারী নির্যাতন রোধে আইন প্রণয়ন করেন। 

 

আমির আমানুল্লাহ খান ১৯২৩ সালে আফগানিস্তানে প্রথম সংবিধান দেন। তাতে তিনি নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেন। নারীদের শিক্ষা এবং ভোটদানের অধিকারও দেন আমানাতুল্লা। তাঁরা ছিলেন নারীকে চার দেয়ালের মধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘোর বিরোধী। তাঁরা নারী পুরুষের ভেদ মানতেন না। মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেওয়া, এক পুরুষের একাধিক বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা বসায় আমানাতুল্লা সরকার। মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়িয়ে ১৬ বছর করা হয়। ১৯২৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সোরাইয়াকে ডিগ্রি প্রদান করে। এবছরই সোরাইয়ার প্রতিষ্ঠিত স্কুল থেকে ১৫ জন নারীকে উচ্চশিক্ষার জন্য তুরস্কে পাঠান তারা। 

 

আমির ও রানী শত শত বছরের প্রাচীন প্রথা নারীদের পর্দা প্রথায় শিথিলতা আনেন। রানী নিজেও পর্দা প্রথায় বিশ্বাসী ছিলেন না, পর্দা পরিধান করতেন না। রক্ষণশীলতার বেড়াজাল কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে মহিলাদের উৎসাহ দিতেন সোরাইয়া। এক সমাবেশে আমানাতুল্লা বছিলেন যে, ইসলামে কোথাও মেয়েদের হিজাব পরার নির্দেশ নেই। সেখানে সকলের সামনেই নিজের হিজাব টেনে ছিঁড়ে ফেলেন সোরাইয়া। তার দেখাদেখি অন্য মন্ত্রীদের স্ত্রীরাও নিজেদের হিজাব ছিঁড়ে ফেলেন। পর্দাকে তাঁরা মনে করতেন নারীর বন্দিত্বের প্রতীক। 

 

তাদের কার্যক্রম বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি তারা। আঞ্চলিক মোল্লারা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। ১৯২৮ সালের ৯ জানুয়ারি মোল্লারা ১৮ দফা দাবি পেশ করে বসে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল- রানী সোরাইয়াকে তালাক দিতে হবে; তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠাতে হবে। তবে রানীর বাবা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ তারজিকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। অবিলম্বে মেয়েদের স্কুলসমূহ বন্ধ করতে হবে। যে ৫০ জন মেয়েকে চিকিৎসাবিদ্যা শেখাতে তুরস্কে পাঠানো হয়েছে তাদেরকে ফেরত আনতে হবে। পর্দা প্রথা চালু করতে হবে। সংস্কারমূলক সকল নতুন আইন ও আদেশ বাতিল করতে হবে। প্রথমে আমিত তা নাকচ করে দেন।

 

আবার ব্রিটিশরাও আমির আমানাতুল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। সেসময় আমির আমানাতুল্লাগ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। ব্রিটিশদের ভয় ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে জোট বাধিয়ে তারা ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত না করে। পরবর্তীতে এই দুই শক্তির সহযোগিতায় ১৯২৮ এ গৃহযুদ্ধ শুরু হয় আফগানিস্তানে। পরের বছর ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে সিংহাসন ছাড়েন আমানাতুল্লা। দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হন তিনি। এক মাস পর ভারতের মুম্বাইয়ে তাদের ছোট মেয়ে ইন্ডিয়ার জন্ম হয়। ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন বলে ছোট মেয়ের নাম 'ইন্ডিয়া' রাখেন আমানাতুল্লা এবং সোরাইয়া। তিনি 'প্রিন্সেস ইন্ডিয়া অব অফগানিস্তান' নামে পরিচিত।  

 

এরপর স্থায়ীভাবে ইতালিতে নির্বাসনে চলে যান আমানাতুল্লা এবং সোরাইয়া। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোমে ছিলেন তারা। ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে সেখানেই মৃত্যু হয় আমানাতুল্লার। তার আট বছর পর ১৯৬৮ সালে সোরাইয়াও মারা যান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সেখানে তাদের শেষকৃত্য হয়।

 

আফগানিস্তানকে কুসংস্কারমুক্ত সমঅধিকারসম্পন্ন একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায় এই দম্পতির। ৭০ বছরের জীবনের অধিকাংশ সময়ই সোরাইয়া পার করেছেন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায়। পুরোপুরি সফল না হলেও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। কেবল আফগানিস্তানের ইতিহাসেই নয়, পুরো বিশ্বের ইতিহাসেই চিরকাল তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ