ঢাকার প্রথম আধুনিক নারী হিসেবে পরিচিত যিনি!
হরিপ্রভা তাকেদা। 'ঢাকার প্রথম আধুনিক নারী হিসেবে পরিচিত' এই নারী। তিনিই প্রথম ভারতীয় নারী হিসেবে জাপান যাত্রা করেন। তখনকার দিনেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কিছু গুণের অধিকারী ছিলেন তিনি। সেসব গুনের কারণেই পেয়েছেন ঢাকার প্রথম আধুনিক নারীর তকমা। চলুন তবে দেখে নেয়া যাক তৎকালীন আধুনিক এই নারীর গল্প-
১৮৯০ সালে তদানীন্তন ঢাকা জেলার খিলগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হরিপ্রভা। তার বাবা শশিভূষণ মল্লিক ছিলেন ঢাকার নববিধান ব্রাহ্মসমাজের সক্রিয় কর্মী। ১৮৯২ সালে তিনি ঢাকায় নিরাশ্রয় মহিলা ও শিশুদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে মাতৃনিকেতন নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। হরিপ্রভার মা নগেন্দ্রবালা মাতৃনিকেতনের দেখাশুনো করতেন। ছোট থেকেই তাই হরিপ্রভাও মাতৃনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তার শৈশব সম্পর্কে খুব একটা খোলসা করে জানা না গেলেও শোনা যায় তিনি ইডেন স্কুলে মেট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। এরপর তার পরিচয় হয় তখনকার সময়ের ঢাকার বুলবুল সোপ ফ্যাক্টরির প্রধান কারিগর জাপানের যুবক ওয়েমন তাকেদার সঙ্গে।
আশ্রমে কাজ করার সুবাদেই তাদের পরিচয় হয়। ১৯০৭ সালে উভয় পরিবারের সম্মতিতে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর তার শ্বশুর শশিভূষণ মল্লিকের সহযোগিতায় ঢাকা সোপ ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন ওয়েমন । তবে বছর খানেক পর ঢাকা সোপ ফ্যাক্টরি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। আর তখনি ওয়েমন ব্যবসার পাট চুকিয়ে সস্ত্রীক জাপানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আর এরপরই হইচই পড়ে যায় পুরো দেশজুড়ে। প্রথম কোন নারীর জাপান ভ্রমণ। দিনাজপুরের মহারাজা তাকেদা দম্পতির জাপান যাত্রার কথা শুনে তাদের ২৫ টাকা উপহার দেন। ঢাকাস্থ জনৈক জাপানি ব্যবসায়ী কোহারা তাদের ৫০ টাকা উপহার দেন। ঢাকার নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে তাদের যাত্রার শুভকামনা করে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। এমনকি হরিপ্রভা জাপানে পৌঁছানোর পর তার আগমন সংবাদ জাপানের দুটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
ঔৎসুক্য, জাপানের সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে লেখেন। ১৯১৫ সালে মাতৃনিকেতনের সহায়তায় তার ভ্রমণ বৃত্তান্তটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে।
যার মাধ্যমেই পরবর্তীতে তার নেতাজীর সঙ্গে পরিচয় হয়। এমনকি রাসবিহারী বসুর মধ্যস্থতায়ই হরিপ্রভা ১৯৪২ সালে টোকিও রেডিওতে আজাদ হিন্দ্র ফৌজের হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠিকার চাকরি পান। কিন্তু তখন উত্তাল ছিল পুরো টোকিও শহর। মিত্র বাহিনী শহরজুড়ে বোমা বর্ষণ অব্যাহত রেখেছিল । সেই পরিস্থিতেও প্রতি রাতে হরিপ্রভা হেলমেট মাথায় দিয়ে টোকিও রেডিও স্টেশনে যেতেন। এবং ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি আজাদ হিন্দ্র ফৌজের হয়ে বাংলায় সংবাদ পাঠ করেছিলেন।
এরপর বিশ্বযুদ্ধ শেষে, ১৯৪৭ সালে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে দেশে ফেরেন হরিপ্রভা। কিন্তু তখন আবার তার জন্মস্থান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। তাই পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে তার বোন অশ্রুবালা মল্লিকের বাড়িতে ওঠেন। পরের বছরই তার স্বামী মারা যান। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পরও ভেঙে পড়েননি হরিপ্রভা। বরং নিজের সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন বারংবার।
তার স্বামী ছিলেন একজন জাপানি। তাই কোন বাধ্যবাধকতা ছিলোনা সকল নিয়মের ক্ষেত্রে। কিন্তু তবুও হিন্দু বা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী বিধবা নারীদের মতো তিনি সাদা শেমিজ ও সাদা থান পরতে আরম্ভ করেন। যা থেকে তার স্বামীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
তখন তার বয়স ছিল আশি ছুঁই ছুঁই। এরপর হরিপ্রভাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
২০১২ সালে হরিপ্রভার প্রথম জাপান যাত্রার শতবর্ষে বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল জাপান ফাউন্ডেশনের সহায়তায় হরিপ্রভার জীবনের উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। যার শিরোনাম ‘জাপানী বধূ’। ইংরেজিতে ‘দ্য জাপানিজ ওয়াইফ’।