রহস্যময় সেই জাহাজ বাড়ি!
ইট পাথুরে ঘেরা নগরীতে বানিজ্যিক বহুতল ভবন দেখে দেখে যখন অভ্যস্ত ছিলো নগরীর মানুষ। ঠিক তখনি তাদের কৌতুহলের অংশ ছিলো সেই নগরীর ভিন্নধর্মী একটি বাড়ি। সাত মসজিদ রোডের ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে চোখে পড়তো খয়েরী রঙের ভিন্নধর্মী একটি বাড়ি। অনেকে আবার একনজর দেখতেও আসতো বাড়িটি। পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে অথচ উৎসুক দৃষ্টিতে থমকে কিছুক্ষণ বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকবেনা এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল। তবে সে সুযোগ এখন আর নেই ২০১৬ সালে বহুতল ভবন নির্মানের উদ্দেশ্যে ভেঙে ফেলা হয় বাড়িটি। কিন্তু তা বলে একফোঁটাও কমেনি বাড়িটিকে ঘিরে সাধারণ মানুষের কৌতুহল। বরং এখনও অনেক মানুষের মাথায় ঘুরপাক এই রহস্যময় বাড়ি। অনেকেই জানেননা কি এই বাড়ির রহস্য, কি এই নামের রহস্য?
তবে চলুন আজ এই রহস্যময় বাড়ি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যাক। যা আপনার কৌতূহল কিছুটা হলেও দূর করতে সাহায্য করবে।
ধানমণ্ডি লেক ঘেষা লাল ইটের তৈরি জাহাজ আকৃতির বাড়িটি স্থাপত্য শিল্পের এক অপরূপ নিদর্শন। এক সময়ের ধানমন্ডি লেকে শোভা বাড়াতো এই ৫/এ রোডের ৬০ নাম্বার জাহাজ বাড়িটি। প্রথম নজর পড়লে এর বিশাল আকৃতির গম্বুজগুলো চোখে পড়লে স্বাভাবিকভাবেই যে কারো মনে হতো কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়। কেউ কেউ আবার মনে করতো এটি কোনো বিদেশী সংস্থার অফিস, কেউ মনে করতো এটি একটি ভৌতিক বাড়ি। আর মনে হওয়াটাও খুব একটা অস্বাভাবিক না। এ বাড়ির সদস্যদের খুব একটা বাইরে দেখা যেতো না। কোলাহল তো দূরের কথা, একদম শুনশান নিরবতা বিরাজ করতে বাড়ির ভেতরে। বাড়ির প্রধান দরজাও সবসময় বন্ধ থাকতেই দেখা যেতো। তাই এসব কারনে বাইরের উৎসুক জনগন মনগড়া ভাবে বাড়িটি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ধারণা পোষণ করে আসছে।
এই বাড়িটি জাহাজ বাড়ি নামে পরিচিত হলেও এর আসল নাম কিন্তু জাহাজ বাড়ি নয়। বাড়ির গেটের নেমপ্লেট অনুযায়ী বাড়ির নাম “Chistia Palace”। অনেকে বলেন, উচ্চারণগত কারণে অনেকে এটিকে ‘খ্রিস্টিয়া প্যালেস’ বলেন। আবার অনেকে বলেন, অনেকে একে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উপাসনালয় ভেবে ' খ্রিস্টিয়া প্যালেস' বলেন। তবে আসলে এর উচ্চারণ হবে ‘চিশতিয়া প্যালেস’। তবে ভাবছেন তো বাড়িটি জাহাজ বাড়ি নামে পরিচিত হওয়ার কারন কি?
১৯৯৩ সালের কোনো এক সময় এই বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছিলো । তার এক বছর পর ১৯৯৪ সালে বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্মাণের পর কোনো এক সময় লেকের পাশ দিয়ে চলাচলের রাস্তা নির্মানের জন্য ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বাড়িটির কিছু অংশ ভেঙে এর পাশ দিয়ে চলাচলের রাস্তা তৈরি করে। তখন বাড়ির মালিক বাড়িটির সীমানা প্রাচীর জাহাজের আদলে তৈরি করেন। আর তারপর থেকে বাড়িটি বাইরে থেকে দেখতে জাহাজের মতো লাগে। আর তাই বাড়িটি ধীরে ধীরে জাহাজ বাড়ি নামে পরিচিত হতে থাকে।
বাড়িটিকে নিয়ে যেমন রয়েছে হাজারো রহস্য। তেমনি বাড়ির মালিককে নিয়েও রয়েছে অনেক রহস্য। রহস্যময় এ বাড়ির মালিকের নাম ‘শের এ খাজা’। স্থানীয়দের মতে তিনি একজন আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবান মানুষ। শুধু দেশে নয় সারা বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে তার সখ্যতা ছিলো । আর এই সখ্যতার মূলে ছিলো তার ভবিষ্যৎবাণীর ফলপ্রসূতা। বলা হয় তিনি যা ভবিষ্যৎবাণী করতেন ঠিক তেমনটিই হতো। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রথম সারির নেতাদের সাথে তার ওঠাবসা ছিল। এমনকি জানা যায় বিশ্বের অনেক বড় বড় নেতাদের পদধূলি পড়েছে এই জাহাজ বাড়িতে। তার ভবিষ্যৎ বাণী অনুসারে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতেন। সে কারনে শেরে খাজাকে বলা হতো ‘কিং অব কিং মেকার’। তবে তিনি ‘শের এ খাজা’ নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম একেএম আনোয়ারুল হক চৌধুরী। জানা যায় ১৯৫২ সালের কোনো একসময় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
আধ্যাত্মিক ক্ষমতার বাইরে তিনি গার্মেন্টস ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। চিশতিয়া গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামে তার একটি কোম্পানির মালিক ছিলেন তিনি। তার স্ত্রীর নাম রেহানা চৌধুরী। তাদের একমাত্র পুত্র রুবেল চৌধুরী ও একমাত্র কন্যা সাদিয়া চৌধুরী। তার ছেলে রুবেল চৌধুরী বিয়ে করেন নেপালের সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজাদা কৈরালার মেয়েকে। তার স্ত্রী সম্পর্কে নেপালের প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার নাতনী। চিশতিয়া প্যালেসে তার পাশাপাশি আরো বসবাস করতেন শেরে খাজার মা, বোন ও তার পরিবার এবং শেরে খাজার স্ত্রী রেহানা চৌধুরী। তার ছেলে রুবেল চৌধুরী। মাত্র ৫৯ বছর বয়সে ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে এই ‘আধ্যাত্মিক’ পুরুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ধারনা করা হয়ে থাকে যে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠাতা শের-ই-খাজার মৃত্যুর পর তার ছেলেমেয়েরা এখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এবং পরবর্তীতে ২০১৬ সালে অদ্ভুত সুন্দর, আকর্ষনীয় এ বাড়িটি ভেঙে বানিজ্যিক ভবন তৈরী করা হয়। এবং যান্ত্রিক শহরে বানিজ্যের কাছে হার মানে শিল্প।