কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন
যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে আজকাল মানুষ বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এরপরও বই যারা পড়তে ভালোবাসে, তারা কবি-কথাশিল্পীদের পছন্দ করবে না, এমনটা হওয়ার নয়। আজ বলবো, এমনই এক নারী সাহিত্যিকের কথা, যিনি একজন কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষকও। তিনি বাংলাদেশের মানুষ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে লেখা-লেখি করেছেন। তিনি সবার প্রিয় সেলিনা হোসেন।
সেলিনা হোসেন নিজের গভীর উপলব্ধিকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, গদ্য নির্মাণে প্রবন্ধ আকারেও উপস্থাপন করেছেন। তিনি বাংলার লোক-পুরাণের উজ্জ্বল চরিত্রগুলোকে নতুনভাবে বেশ কয়েকটি উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নতুন মাত্রা যোগ করেছেনে তার লেখায়।
সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার হাজীরপাড়া গ্রামে। তার বাবা এ কে মোশাররফ হোসেন ছিলেন রাজশাহীর রেশম শিল্প কারখানার পরিচালক এবং মা মরিয়মন্নেসা বকুল ছিলেন গৃহিণী।
সেলিনা হোসেনের শৈশব কাটে বাবার কর্মস্থল বগুড়ায়। তিনি বেড়ে ওঠেন অবাধ স্বাধীনতা ও উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে। তার প্রতিদিনের কাজের মধ্যে ছিল মাঠে-ঘাটে, নদীতে ঘুরে বের হওয়া, উঁচু গাছে চড়ে বাবার বকুনি খেয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়া ও ভাই-বোনদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে স্কুলে যাওয়া।
সেলিনা হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে বগুড়ার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে। সে সময় কাগজ-কলমে লেখার অভ্যাস না থাকায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত চক-শ্লেটে লিখতে হতো। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে বাংলায় বিএ অনার্স ও ১৯৬৮ সালে এমএ পাস করেন সেলিনা হোসেন।
তার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমীর গবেষণা সহকারী হিসেবে। আগে তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় উপ-সম্পাদকীয় লিখতেন। তিনি বাংলা একাডেমীতে কর্মরত অবস্থায় বাংলা একাডেমীর ‘অভিধান প্রকল্প’, ‘বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রকল্প’, ‘বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী প্রকাশ’, ‘লেখক অভিধান’, ‘চরিতাভিধান’ ও ‘একশত এক সিরিজের’ গ্রন্থগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ২০ বছরের বেশি সময় থেকে ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমীর প্রথম মহিলা পরিচালক হন এবং এই পদে থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
২০১৪ সালে তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান হিসেবে দুই বছরের নিয়োগ পান। এরপর ২০২২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর সভাপতির দায়িত্বে নিয়োজিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৬৯ সালে সেলিনা হোসেনের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয়। এই কথাসাহিত্যিকের লেখালেখির শুরু হয় ষাটের দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী মহিলা কলেজে পড়াশোনার সময় থেকে।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ও ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’গল্প দুটি নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। শিলাচরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পাঁচটি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি ২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটোন কলেজের সাহিত্য বিভাগে দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য কোর্সের পাঠ্যসূচি-ভুক্ত হয়।
তার রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, ‘উত্তর সারথি’ (১৯৭১) ‘জলোচ্ছ্বাস’ (১৯৭৩), ‘জ্যোৎস্নায় সূর্যজ্বালা’ (১৯৭৩), ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ (১৯৭৯), ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ (১৯৮২), ‘পদশব্দ’ (১৯৮২), ‘চাঁদবেনে’ (১৯৮৪), ‘ক্ষরণ’ (১৯৮৮), ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ (১৯৮৯), ‘খুন ও ভালোবাসা’ (১৯৯০), ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ (১৯৯২), ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ (১৯৯২), ‘টানাপোড়েন’ (১৯৯৪), ‘দীপান্বিতা’ (১৯৯৭), ‘যুদ্ধ’ (১৯৯৮), ‘লারা’ (২০০০), ‘মোহিনীর বিয়ে’ (২০০১), ‘আণবিক আঁধার’ (২০০৩), ‘ঘুমকাতুরে ঈশ্বর’ (২০০৪), ‘মর্গের নীল পাখি’(২০০৫), ‘অপেক্ষা’ (২০০৭), ‘দিনের রাশিতে গিটঠু’ (২০০৭), ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ (২০০৭), ‘পূর্ণছবির মগ্নতা’ (২০০৮), ‘ভূমি ও কুসুম’ (২০১০), ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’(২০১১), ‘আগস্টের একরাত’ (২০১৩), ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’ (২০১৪), ‘দিনকালের কাঠখড়’ (২০১৫) প্রভৃতি।
তার মোট উপন্যাসের সংখ্যা ৩৫টি, গল্প গ্রন্থ ১৩টি, ২২টি শিশু-কিশোর গ্রন্থ এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ১০টি। এছাড়াও ১৩টি সম্পাদনা গ্রন্থ রয়েছে।
সেলিনা হোসেনের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তার উপন্যাস অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশ, মেলে ও কানাড়ি ভাষায়।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য সেলিনা হোসেন ভূষিত হয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে। তিনি ২০১০ সালে একুশে পদক পান এবং একই বছরে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট উপাধি দেয়।
অনন্যা/এসএএস