পাহাড়ধস-হতাশা-ক্লান্তি পেরিয়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় সিসিলি স্কগ
২০০৮ সালের এক আগস্ট। ভীষণ ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। এই প্রচন্ড ঠান্ডাতেই আরোহীরা পর্বতারোহন চালিয়ে যাচ্ছেন। আর মাত্র একদিন। উত্তর পাকিস্তানের কেটু পর্বতে আরোহন করবেন তারা। আটটি ভিন্ন দেশের সর্বমোট ৩১ জন আরোহী এই পর্বতারোহন অভিযানে এসেছে। কেটু পর্বতটি একটু অদ্ভুত। দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো। এভারেস্ট থেকে ছোট হলেও বিগত কয়েক দশক ধরেই অভিযাত্রীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে এই পাহাড়।
আরো ৪৮ ঘণ্টার মাঝেই এই ১১ জন নিয়তির অদ্ভুত খেলায় হারিয়ে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে। হিমালয়ের ইতিহাসে অন্যতম কালো অধ্যায়ের একটি হয়েই সমগ্র পৃথিবীতে চিহ্নিত হবে।
কেটু পর্বত বেয়ে ওঠার সময় থেকেই আবহাওয়া অশনি সংকেত দিতে শুরু করেছিলো। এমন সময় এক দমকা বাতাস এসে কেটুর একটি বরফের চাঙর ভেঙে পড়ার উৎসাহ দিয়ে মিলিয়ে যায়। একসাথে অসংখ্য পেজা তুলোর মতো বরফ নিচে ধ্বসে পড়তে শুরু করে। এই বরফের স্রোতেই একজন একদম গভীরে হারিয়ে গেলো। সেইসাথে গেলো নিচে নামার জন্যে রাখা ফিক্সড দড়ি।
কেটুর সেই তথাকথিত ডেথ জোনে এখন সকলেই আটক। কারো কাছেই দড়ি নেই নিচে নামবে। অক্সিজেনের অভাবে যে কারোই মনোবল ভেঙে যাওয়ার কথা। তবু বেঁচে থাকা আরোহীরা জীবনের মূল্য বুঝেছিলেন। তারা কোনোমতে নিচে নেমে এসেছিলেন।
অর্থাৎ অন্তত ২০ জন তার ঘরে ফিরে যেতে পেরেছিলেন। প্রতিবছর আরোহীরা নানা দূর্ঘটনার শিকার হন। পেছনে রেখে যান পরিবার বা প্রিয়জন। যে ১১ জন মৃত্যুবরণ করেন, তাদের আটজনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। কারো বাড়িতে দাদা-দিদিমা কিংবা আত্নীয়রা অপেক্ষায়। একজনের ছয়টি ছোট ছোট বাচ্চাও আছে। এই মৃত্যু সেসকল পরিবারে ভীষণ প্রভাব ফেলেছিলো।
সেই প্রভাবটি ঘটনার পরবর্তী সময়েও তার কালো ছায়া রেখেছিলো পরিবারের সদস্যদের উপর। হয়তো সব পরিবারের গল্প বলা সম্ভব না। আমরা একটি ঘটনা বলতে পারি যেখানে সমগ্র বিশ্ব মুগ্ধ হয়ে দেখবে অভিযাত্রী জগতের আরেক কিংবদন্তী নারীকে। সিসিলি স্কগ, যিনি কিনা পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাত চূড়া এবং দুই মেরুতে পৌঁছে গড়েছেন বিশ্বরেকর্ড।
সিসিলি স্কগের জীবনের বিশাল একটি অংশ জুড়েই অ্যাডভেঞ্চার। নিজের অদম্য আগ্রহে তিনি একজন দক্ষ পর্বতারোহী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই স্কি আর হাইকে হাতেখড়ি তার। সানমোরে বাবা মার কেবিন ছিলো একটি। সুযোগ পেলে হাইকিং এর জন্যে সেখানেই চলে যেতো সিসিলি। তবে পর্বতারোহনের প্রতি ভালোবাসা তার হশুরু হয় ১৮-১৯ বছর বয়সে। তখন থেকেই ধরে নিয়েছিলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাত পর্বত বেয়ে উঠবেন।
আর এই চলার পথে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন আরেক অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী স্বামী রলফ ব্যা। যখন অন্যান্য দম্পতিরা ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে নিজেদের গুটিয়ে রাখতে ব্যস্ত, এই দম্পতি নিজেদের অনন্য উচ্চতায় দেখার স্বপ্নে আকূল।
প্রথম দেখা রাশিয়ার মাউন্ট এলব্রাসে। সেই ২০০৩ সালের অভিযানের পর দুজনের সখ্যতা। ২০০৭ সালে বিয়ের ঠিক দেড় বছর পরই দুজনে কেটু অভিযানে যাবেন। নরওয়েতে ফিরেই তারা এক্সপিডিশন পরিচালনার একটি ব্যবসা খুলে বসেন। সিসিলির মনে হয়েছিলো থিতু হওয়া প্রয়োজন। একটা বাচ্চাকাচ্চা হলেই ঘরটা পূর্ণ হয়। একটু বড় হলে তাকেও পর্বতে নিয়ে যাওয়া যাবে। এ সময় স্থানীয় এক হাসপাতালে নার্সের কাজ জুটিয়ে নিলেন।
রলফের অবশ্য তাতে সায় নেই। অভিযানের পর ভেবে দেখা যাবে বলেছিলেন। সে কি আর হলো? সিসিলি থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে অবস্থানরত রলফ বরফের স্রোতে ভেসে গিয়েছিলো নিচের গভীর অন্ধকারে। সিসিলি আবেগ সংযত করে নিচে নেমে এসেছিলেন। বেজ ক্যাম্পেই রলফের বাবা মাকে তাদের একমাত্র সন্তানের মৃত্যুসংবাদ জানান। ভীষণ দুঃখের সময়ে রলফের বাবার কথাটুকুই স্বান্তনা মাত্র, “ইটস ওকে। আমাদের এখন একমাত্র তুমিই আছো। তাই নিরাপদে নেমে আসো ওখান থেকে।”
নরওয়ে ফিরে আসার পর নিজেদের এপার্টমেন্টে আসতেই ভেঙে পড়েন সিসিলি। এই শূণ্যতা মেনে নেয়া সম্ভব না। তাই বাবা-মার সাথেই থাকা শুরু করলেন। বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের অনুপ্রেরণায় এই শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন সিসিলি। অভিযাত্রা থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলার মতো অবস্থাও হয়নি। পাহাড় তাকে তখনো টানে। শুধু এতদিনের সঙ্গীকে হারানোর দুঃখটাই তাকে পোড়াচ্ছে। একসাথে কত কিছু করা বাকী।
তবে পাহাড়ের ভয়টা একটু কাজ করেছিলো। তাই এবার ভিন্নপথে যাত্রা শুরু করলেন সিসিলি। ২০১৪ সালে পৌঁছে গেলেন গ্রিনল্যান্ড। মূলত স্কিতে করে তিনি এন্টার্কটিকা দিয়ে গ্রিনল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন। পরে ক্যানোয়ে দিয়ে নর্থ পোল পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন। সে বছরই নিউ ইয়র্কে পৌছে পুরোনো সিসিলিকে আবার দেখা গেলো।
স্বামীর মৃত্যুর বিষয়ে বলেন, ‘আমি খুশি রলফ যেভাবে জীবন যাপন করতে চেয়েছিলো সেভাবেই পেরেছে। ও আমাকে একটি মূল্যবান বিষয় শিখিয়েছে। নিজের স্বপ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কিছু নেই। বরং দুই হাত দিয়েই আকড়ে ধরা উচিত।’
দুই মেরুকে জয়ের পর সিসিলি পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাত চূড়াতেও আরোহন করেন। ভেঙে পড়েননি তিনি। বরং আরো নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন। সমগ্র পৃথিবীর পর্বতারোহীদের কাছে ততদিনে সিসিলি একজন রোল মডেল। বিশেষত নারীদের জন্যে। অনেকে তাকে বলেছিলেন সেবার না গেলেই হতো। এত ঝুঁকিতে যাওয়ার মানে নেই। কিন্তু সিসিলি রলফের কথাটাও মাথায় রেখেছিলেন।
কিন্তু কেটুর উপর আতঙ্ক তার কাটেনি। পৃথিবীর ভয়ংকর উচ্চতা পাড়ি দিয়েও সেই ভয় সিসিলি কাটাতে পারেননি। ২০১৫ সালে রলফের বাবাকে নিয়ে রলফের নামে একটি মনুমেন্ট স্থাপন করতে যান। এপিটাফটি স্থাপন করে একবার গর্বোদ্ধত পাহাড়ের দিকে তাকান। একটু আতঙ্ক কাজ করেছিলো তখনো। আগেই বলে নিয়েছিলেন কেটুতে তিনি আর কখনো আরোহন করবেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা এবং ভয়ংকর পর্বতে আরোহন না করায় কিছুটা রোমাঞ্চ তাকে বিসর্জন দিতেই হবে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম লেখানো এই সাহসী নারী বুঝতে পেরেছিলেন আরেকটি মূল্যবান কথা। স্বজনদের চিন্তার কথা।
সেজন্যেই তিনি আরোহীদের নিরাপত্তা এবং পরিবারদের স্বান্তনার বিষয়েও বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। আর তার জন্যে বেছে নিয়েছেন ইন্টারভিউ কিংবা পাবলিক স্পিকিং। সুযোগ হলেই নিজের অভিজ্ঞতা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেন। নিজের স্বপ্নকে আকড়ে ধরা শিখেছেন সিসিলি। সেইসাথে হয়েছেন আরো কমনীয়। এই গল্পটি শেষ করার যাবে শুধু সিসিলির একটি উক্তি দিয়ে – ‘আমি আপাতত কেটু বেয়ে ওঠার কথা ভাবতেও পারিনা। আমি নিজেও জানিনা মায়ের চোখে চোখ রেখে পুরোনো আত্নবিশ্বাসের সাথে বলতে পারবো কিনা যে মা আমি কেটু চড়বো। যেকোনো এক্সপিডিশনে যাওয়ার সময় সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো প্রিয়জনদের দুশ্চিন্তায় রেখে যাওয়া। সেই দুশ্চিন্তা দূর করার জন্যে কোনোদিন ফিরে আসতে পারবো কিনা সেই নিশ্চয়তাও নেই।’
অনন্যা/এআই