নতুন বছরে নতুন উচ্চতায় নারী
২০২৪ সালের পুরোটাজুড়েই ছিল দেশের সাহসী নারীদের নানা অর্জন। বাংলার বাঘিনীদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয় থেকে বিশ্বের অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রিকতা আখতার বানু কিংবা মার্কিন সাময়িকী টাইমসের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম, কি নেই সেখানে!
পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের নারীরা। চাকরি, ব্যবসা, খেলার মাঠ গৃহস্থলি সবখানেই যেন তার জয় জয়কার। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও কুসংস্কারকে তুচ্ছ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এখন তারা কর্মক্ষেত্রের উচ্চ আসনে। সরকারি-বেসরকারি সবক্ষেত্রেই নারীদের অংশীদারিত্ব রয়েছে। বিশেষ করে দেশের পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন কল-কারখানা, কৃষি, সেবা খাত এবং নানামুখী উৎপাদনে নারীদের ভূমিকা এখন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ক্রীড়াক্ষেত্রেও দেশকে এগিয়ে নিয়েছে নারী। ইটভাঙা শ্রমিক থেকে শুরু করে বিমান চালনা পর্যন্ত বিভিন্ন পেশায় তারা গড়ে তুলছে সাফল্যের অনবদ্য কাব্য। অবদান রাখছে অর্থনৈতিক উন্নয়নেও।
অর্থনীতি ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারী- পুরুষের যৌথভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে দেশে গণতন্ত্র উন্নয়ন, সুসংহত হবে; তেমনি সুশাসন দৃঢ় হবে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় নারী আর পিছিয়ে নেই। নারীর অগ্রগতি ও উন্নয়ন হয়েছে তার বড় প্রমাণ নারীর ক্ষমতায়ন।
বাংলাদেশি নারীর এভারেস্ট জয়
১৯৭৫ সালের মে মাসের ১৬ তারিখ। এ বছরের মতো সেদিনও মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া ছুঁয়ে দেখতে গিয়েছিলেন অভিযাত্রীরা। পৃথিবীর উচ্চতম সেই শৃঙ্গের শিখরে বরফের স্তর এক ইঞ্চি না বাড়লেও সে দিনটা ইতিহাসে খানিক ভিন্নই ছিল মনে হয়। কারণ, সেদিন বেসক্যাম্পে পৃথিবীর সেরা আর দক্ষ পুরুষ অভিযাত্রীদের সঙ্গে ছিলেন জাপানের এক গৃহবধূ জুনকো তাবেই। কী অপূর্ব স্পর্ধা! অবশ্য তাবেই যেদিন এভারেস্ট সামিটে সফল হন, এর মাত্র ১১ দিন পর, ২৭ তারিখ এভারেস্টে পৌঁছান আরেক নারী, মিসেস ফান্টোগ। মানে প্রায় কাছাকাছি সময়ে পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই নারী রোমাঞ্চের স্বাদ পেতে চেয়েছিলেন, পেয়েছেনও বটে। এরপর একে একে অনেক নারী পৃথিবীর উচ্চতম সেই পাহাড়চূড়া জয় করেছেন। সেই ইতিহাসে লেখা আছে আমাদের দেশেরও দুজন নারীর নাম নিশাত মজুমদার আর ওয়াসফিয়া নাজরীন। ২০১২ সালে এভারেস্ট জয় করেন তারা। এরপর গত এক যুগে দুজন পুরুষ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করলেও নেই কোনো নারীর নাম।
মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা প্রথম বাংলাদেশি নারী নিশাত মজুমদার একটি প্রেরণাদায়ী নাম। তিনি কেবল নিজের সাফল্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি; বরং অন্য নারীদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তার লক্ষ্য শুধু পর্বতশৃঙ্গ জয় করা নয়, বরং সমাজে নারীদের প্রতি প্রচলিত কুসংস্কার ও সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো। তার অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস হচ্ছেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তার লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কেবল একটি গল্প নয়; এটি নারী স্বাধীনতার প্রতীক এবং একটি বৈপ্লবিক ধারণার উৎস। সম্প্রতি এই লেখাটি ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
‘সুলতানা’স ড্রিম আনবাউন্ড’: একটি ঐতিহাসিক অভিযান
নিশাত মজুমদার ও তার দল এই মুহূর্তে নেপালের লাংটাং অঞ্চলে একটি বিশেষ অভিযানে অংশ নিয়েছেন। অভিযানের নাম ‘সুলতানা’স ড্রিম আনবাউন্ড’। লক্ষ্য-৫ হাজার ৫০০ মিটারেরও বেশি উচ্চতার তিনটি শৃঙ্গ জয় করা: নায়া কাঃ, ব্যাডেন পাওয়েল, ও ইয়ালা পিক। এই দুঃসাহসিক অভিযানে নিশাতের সঙ্গে আছেন বিভিন্ন পেশা ও অভিজ্ঞতার নারীরা।
অভিযানে অংশগ্রহণকারী অন্য সদস্যরা হলেন- পর্বতারোহী ইয়াসমিন লিসা, তাহেরা সুলতানা রেখা, ট্রেকার এপি তালুকদার ও অর্পিতা দেবনাথ। অভিযানে নতুন প্রশিক্ষণার্থী ট্রেকার এপি ও অর্পিতা বেইজক্যাম্প পর্যন্ত ট্র্যাক করবেন। অপর তিনজন নয়া কাঙ্গা (৫ হাজার ৮৪৪ মিটার), ব্যাডেন পাওয়েলে পিক (৫ হাজার ৮৫৭ মিটার) ও ইয়ালা পিকে (৫ হাজার ৫০০ মিটার) আরোহণ করবেন।
ইয়াসমিন লিসা
ইয়াসমিন লিসা একজন পর্বতারোহী, দক্ষ দৌড়বিদ এবং নিবেদিতপ্রাণ সামাজ কর্মী। ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের বিভিন্ন পর্বতশৃঙ্গে আরোহন করেছেন। এর বাইরে দেশে আয়োজিত বিভিন্ন দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে থাকেন। ইয়াসমিন লিসা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে কর্মরত রয়েছেন। তহুরা সুলতানা রেখা
তহুরা সুলতানা রেখা একজন উদ্যোক্তা যিনি চাকরি ছেড়ে নিজের ব্যবসা শুরু করেছেন। চাকরি বা ব্যবসার পাশাপাশি তিনি ট্রেকিং, হাইকিং এবং ক্লাইম্বিংসহ বিভিন্ন দুঃসাহসিক কাজে অংশ নিয়ে থাকেন। সম্প্রতি ‘ইতিবাচকতা প্রচার করুন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য হাঁটুন’- এ বার্তা ছড়িয়ে দিতে তিনি টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত হাইকিং করেন।
মৌসুমি আক্তার
মৌসুমি আক্তার একজন ক্রীড়াপ্রেমি যিনি একাধারে একজন অভিযাত্রী, সাইক্লিস্ট ও ম্যারাথন রানার। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চট্টগ্রামের একটি স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এর বাইরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সক্রিয় রেফারি হিসেবেও কাজ করছেন।
অর্পিতা দেবনাথ
সম্প্রতি মাইক্রোবায়োলজিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা অর্পিতা একজন সমাজ কর্মী। সমাজের উন্নয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছেন তিনি। দলটি এক ভিন্নধর্মী উদ্যোগের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে। এই নারীরা একে অন্যের সহযোগিতায় নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে প্রমাণ করছেন, দলগত প্রচেষ্টা এবং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে কোনো স্বপ্নই অসম্ভব নয়।
সীমাবদ্ধতাকে জয়
বাংলাদেশি নারীদের জন্য পর্বতারোহণ শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও সামাজিকভাবে চ্যালেঞ্জিং। আমাদের সমাজে পর্বতারোহণের মতো কাজের সঙ্গে নারীদের জড়ানো অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু নিশাত ও তার দল সেই সমস্ত প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন।
তারা দেখিয়েছেন, যখন নারীদের সুযোগ দেওয়া হয় এবং তাদের স্বপ্ন দেখার সাহস জোগানো হয়, তখন তারা নিজেদের ক্ষমতা দিয়ে দুনিয়াকে চমকে দিতে পারে।
এই অভিযাত্রী দলের প্রতিটি পদক্ষেপ বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পের আদর্শকে বাস্তবায়িত করছে। তারা আমাদের মনে করিয়ে দেন, নারীরা নিজেদের প্রতিভা দিয়ে বিশ্বের কঠিনতম চ্যালেঞ্জগুলো জয় করতে পারে।
নিশাত মজুমদার ও তার দল লাংটাংয়ের শিখরে পৌঁছে শুধু পর্বত জয় করছেন না; তারা প্রমাণ করছেন, নারীদের সুযোগ দেওয়া হলে তারা কেবল সমাজের জন্যই নয়, পুরো বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে পারে। তাদের এই যাত্রা নারীর ক্ষমতায়ন এবং সমতার পথে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ; এগিয়ে যাচ্ছে নারী। নারীর ক্ষমতায়নে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখন বাংলাদেশ, যা বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই রোল মডেল। খেলাধুলা, বিজ্ঞান, গবেষণা, আবিষ্কার, রাজনীতি, প্রশাসন, পররাষ্ট্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব ক্ষেত্রেই নারীর লক্ষণীয় সরব উপস্থিতি। প্রথম নারী স্পিকার, প্রথম নারী উপাচার্য, প্রথম নারী পর্বতারোহী, বিজিএমইএর প্রথম নারী সভাপতিসহ অসংখ্য পদাধিকারী প্রথম দেখেছি আমরা। তাদের পথ ধরে নতুনরা প্রতিনিয়ত নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছেন। অগ্রযাত্রায় তরুণ যাত্রীদের অংশগ্রহণ উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করেছে।