গুডটাচ-ব্যাডটাচ সম্পর্কে শিশুকে বোঝাতে হবে
বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে শিশুরাও বিশেষভাবে যৌন হয়রানি, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ঘরে-বাইরে কোথাও তারা নিরাপদ নয়। এমনকি জ্ঞানের আলো ছড়ায় যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাতেও ছেলে-মেয়ে কেউই নিরাপদ নয়। বর্তমানে একশ্রেণির বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ শিশুদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের দিয়ে বিকৃত লালসা পূর্ণ করছে। যার প্রভাব দিনকে দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
বেশকিছুদিন পূর্বে ভারতের বিহারের স্কুলের এক শিক্ষিকা শিশুদের গুডটাচ-ব্যাড টাচ সম্পর্কে সঠিকভাবে শিক্ষা প্রদানের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে দেখা যায় তিনি শিশুদের এ সম্পর্কে সচেতন করে তুলছেন। কিন্তু আমাদের দেশে স্কুলে এ ধরনের উদ্যোগ এখনও সদৃশ্য নয়! তবে আমাদের দেশেও শিশুরা বিভিন্নভাবে অনিরাপদ হয়ে উঠছে। তাই আমাদের দেশেও এ ধরনের সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়েজন। যা তাদের বোধ তৈরি করতে সাহায্য করবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবসময়ই আলোর পথে চলতে শিক্ষা দেয়। তবে সেই আলো শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় যেন সীমাবদ্ধ না থাকে। কোমলমতি শিশুরা যাতে তাদের চলার পথেও কাজে লাগাতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, ভালো-মন্দের জ্ঞান যেমন দেওয়া জরুরি ঠিক তেমনই নিরাপত্তার খাতিরে গুড টাচ, ব্যাড টাচ সম্পর্কেও সমানভাবে শিক্ষা দিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সামনে ছোট ছোট সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন, ভিডিওচিত্র দেখাতে হবে। লজ্জা বা কোনপ্রকার সংকোচের দিনশেষ। সন্তানদের নিরাপদে বেড়ে তুলতে এখন সময়ের প্রয়োজনীয়তাকে মানতে হবে। গোঁড়ামি করে সন্তানকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না।
শিশুদের ছোট থেকেই ‘গুড টাড-ব্যাড টাড’ বোঝা জরুরি। ভারতীয় শিক্ষিকা খুদে পড়ুয়াদের সাবলীলভাবে শিখিয়েছেন ভাল এবং খারাপ স্পর্শের মধ্যে পার্থক্য কী? ওই শিক্ষিকার বৌদলতে হলেও আমাদেরও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। আর চুপ থাকার সময় নেই। দিন দিন বাচ্চারা এতটা অনিরাপদ হচ্ছে সে থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারে এ ধরনের উদ্যোগ।
আজকাল ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছে। তাই যৌন শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেছে প্রশাসনও। সেই প্রেক্ষিতে ঠিক স্পর্শ বোঝা এবং ভুল স্পর্শ বুঝতে পারলে যে জোর গলায় প্রতিবাদ করতে হয় তাও বুঝিয়েছেন ওই শিক্ষিকা। ভাইরাল ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, শিক্ষিকা যখন এক খুদে ছাত্রীর বুকে ও থাইয়ে হাত দেন তৎক্ষণাৎ সেই পড়ুয়া হাত নাড়িয়ে বোঝায় যে এটি ব্যাড টাচ। এমনকী শিক্ষিকা যখন শিশুকে বলে, ‘আমি তো ভালোবাসছি’, তখনও ছাত্রী জোর গলায় বলে, ‘না এটা ব্যাড টাচ’। এরপর আদর করে কাছে টেনে শিক্ষিকা বুঝিয়ে বলেন, ‘বাড়ির কোনও গুরুজনও এমন ব্যাড টাচ করলে সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ করতে হবে।’ আমাদের স্কুল-মাদ্রাসাগুলোতেও কোমলমতি শিশুদের এমন শিক্ষা প্রদানে অগ্রসর হতে হবে। বহুদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে চর্চা চললেও এ নিয়ে তেমন কোন সতর্কতামূলক কার্যক্রম আজও চোখে পড়ছে না!
স্পর্শ কখনও কখনও নিছক ছোঁয়া নয়। তার মধ্যে থাকে বিকৃতি কিংবা দুরভিসন্ধি। তাই তো শিশুদের ছোট থেকেই ‘গুড টাড-ব্যাড টাড’ বোঝা জরুরি। তবে শুধু পুঁথিগত বিদ্যাই নয়, সহজভাবে মেশার মাধ্যমে খুদেদের বোঝানো উচিত স্পর্শের আসল উদ্দেশ্য। ঠিক যেমনটা করেছেন ওই ভারতীয় শিক্ষিকা। যিনি খুদে পড়ুয়াদের সাবলীলভাবে শিখিয়েছেন ভাল এবং খারাপ স্পর্শের মধ্যের পার্থক্য কী!
দেশে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে শিশুধর্ষণের ঘটনা। শিশুরা পথেঘাটে যেমন, তেমনি বাসাবাড়িতেও আর নিরাপদ নয়। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা খেলার মাঠেও তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কন্যাশিশুরাই কেবল নয়, ছেলেশিশুরাও ধর্ষকদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। অপরাধ বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও সমাজকর্মীরা বলছেন, পরিবারের সচেতনতার অভাব, শিশুদের গুড টাচ, ব্যাড টাচ সম্পর্কে সচেতন না করার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে সবাই এ সম্পর্কে বলেই খালাস! কারো কোনো পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয়। বর্তমান কারিকুলামে এ ধরনের শিক্ষা অন্তভূক্ত করা এখন সময়ের দাবি। এবং প্রত্যেক স্কুলে একটি করে মতামত বক্স থাকা জরুরি যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের অভিযোগ, সমস্যা সম্পর্কে তুলে ধরতে পারবেন।
শিশুকে Good-tauch, Bad-tauch সম্পর্কে সচেতন করতে হবে নতুবা বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। বাড়িতে অন্ধ বিশ্বাসে যে কারও অবাধ আনাগোনা বন্ধ করতে হবে। শিশুকে যেখানে-সেখানে যে কারও সঙ্গে বেরুতে দেওয়া যাবে না এদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বাবা-মাকে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যাতে শিশু তার মনের সব কথা বাবা-মাকে জানাতে ভশ না পায়। এবং অন্যায়ের জোরালো প্রতিবাদ করার মানসিক দৃঢ়তা অভিভাবকদের থাকা বাঞ্ছনীয়। এছাড়া আইনের মাধ্যমে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলতে হবে। তবে সেই সচেতনতার প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ শিশুকে গুডটাচ- ব্যাড টাচ শিক্ষা দেওয়া।
ধর্ষণ, গুড টাচ, ব্যাড টাচ বিষয়গুলো এখনো ট্যাবু হয়ে আছে, ‘এগুলো বাচ্চাদের জানার বিষয় না’ বলে আমরা তাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। অভিভাবকদের বাচ্চাকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া, সতর্ক না থাকা ও শিশুর সঙ্গে খোলামেলাভাবে এসব বিষয়ে আলাপ না করার কারণেও একই ঘটনার সূত্রপাত হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে সবাই কী বলবে, মান সম্মান থাকবে না; এসব ভেবে শিশুর পরিবার মুখে রা করে না। আবার করলেও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার হয়রানি, ধর্ষক প্রভাবশালী ব্যক্তি হলে তার হুমকি, একটা করাপ্টেড সিস্টেমের নিচে নিষ্পেষণের কারণে সমাজে মহামারীর মতো বেড়ে চলেছে শিশুধর্ষণ। এ থেকে রক্ষা পেতে সবার সচেতন প্রয়াস আবশ্যক নতুবা আগামীর শিশুরা আরও ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য হবে!
বর্তমান সময়টা যে পরিমাণ যান্ত্রিক ও অসাধুদের আনাগোনা পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে সন্তানকে ছোট থেকেই সমাজের খারাপ বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচয় করানো জরুরি। শুধু ওয়াকিবহাল থাকাই নয়, প্রয়োজন যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সঠিক শিক্ষাও দিতে হবে। মানসিক সাপোর্ট গড়ে তুলতে হবে। আর শিশুদের বাবা-মা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চেয়ে কে বা ভালো শিক্ষা দিতে পারে! তাই বাড়িতে অভিভাবকরা সন্তানদের ব্যাপারে যেমন উদ্যোগী হবেন ঠিক পাঠ্যের বাইরে এসব শিক্ষা বিদ্যালয়েও দিতে হবে। নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া বিহারের ওই শিক্ষিকার থেকে অন্তত এটুকু বোধ আমাদেরও জন্মানো উচিত যে, আর চুপ থাকার সময় নেই। সংকোচকে হটিয়ে সচেতন করতে হবে। যৌন হয়রানির মতো বিকৃত মস্তিষ্ককে রুখতে হলে আওয়াজ তুলতে হবে। গুড টাচ- ব্যাড টাচ সম্পর্কে সঠিকভাবে শিক্ষা প্রদান করতে হবে।
নিরাপদ পৃথিবীতে বেড়ে উঠুক আমাদের প্রত্যেকটি সন্তান। তারাই আমাদের আগমী। তাই তাদের সঙ্গে কোনোপ্রকার ছলচাতুরী নয়। শিক্ষা হোক খোলামেলা যার দ্বারা জীবনবোধের সুশিক্ষা পেয়ে দেশ-দশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে সক্ষম হয়। শিশুদের সুস্থ ও নিরাপদ জীবন গঠন একটি জাতির ভবিষ্যতকে বিনির্মাণের সামিল । এজন্য জাতিকে জাগতে হবেই।