প্রবাসী নারীরা আর কত নির্যাতিত হবে
আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অপ্রতুল সুযোগ থাকায় অনেকেই বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। একটু সুখের মুখ দেখবেন বলেই তারা এসব দেশে যান। নিজের ভিটেমাটি এমনকি শেষ সম্বলটুকু বেচে বা বন্ধক রেখে তারা বাইরে যাওয়ার মতো অর্থ জোগাড় করেন। তাদের স্বপ্ন থাকে একটাই: ভালো থাকবেন। অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি পাবেন।
কিন্তু সম্প্রতি উঠে আসছে ভয়াবহ কিছু তথ্য! বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীরা কর্মের জন্য গেলে তাদের বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। এই নারীরা নানাভাবে মালিকের দ্বারা হেনস্তার শিকার হন। প্রবাসফেরত এসব নারীর ভাষ্য, তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের এমনভাবে শারীরিক নির্যাতনের শিকার করে তোলা হয়েছে যে, তারা সহ্য করতে না পেরে যেভাবেই হোক দেশে ফেরত আসার জন্য প্রিয়জনের কাছে আকুল আবেদন জানান।
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে নারী শ্রমিকের লাশ দেশে আসছে। সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে লাশের সঙ্গে মৃত্যুর সনদ দেওয়া হয়। বেশিরভাগক্ষেত্রে এই সনদে মৃত্যুর কারণ ‘স্বাভাবিক’ লেখা হয়। বিশেষ করে গত তিন বছরে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’লেখা সনদের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হওয়া এসব নারী শ্রমিকের অধিকাংশের বয়স ৪০ বছরের নিচে। পরিবারের সদস্যসহ অভিবাসন-বিশেষজ্ঞরা এই ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ কতটা স্বাভাবিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তারা সন্দেহ প্রকাশ করছেন, এই মৃত্যুর আসল রহস্য কোথায় আটকে আছে!
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২০২০ থেকে ২০২২ সালের তথ্য মতে, এই তিন বছরে ৪০৪ জন নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। তাঁদের মধ্যে ২২৭ জনের ক্ষেত্রে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’লেখা ছিল। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক দেশে আসা নারী শ্রমিকদের লাশের তথ্য আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করে। এই সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় , ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ৭১৪ নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে। তাঁদের মধ্যে ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যুর সনদ লেখা লাশের সংখ্যা ২৬২। আর ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে ৩১৯ নারী শ্রমিকের লাশ দেশে আসে। তাদের মধ্যে ২২০ জনের ক্ষেত্রে লেখা ছিল ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’। এত নারীর স্বাভাবিক মৃত্যুর খবরটা কতটা স্বাভাবিক, তা আমরা অনুমান করতে পারি।
ব্র্যাকের গত সাত বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এই সময়ে যেসব নারী শ্রমিকের লাশ দেশে এসেছে, তাদের মধ্যে ১৩৮ জনের মৃত্যুর কারণ লেখা ছিল ‘স্ট্রোক’। ১১৬ জনের ক্ষেত্রে ‘আত্মহত্যা’। ১০৮ জনের ক্ষেত্রে ‘দুর্ঘটনা’। ১৬ জনের ক্ষেত্রে ‘হত্যা’। এর বাইরে করোনা, ক্যানসার, অজানা রোগ বা কোনো কারণ উল্লেখ না করেই দেশে নারী শ্রমিকের লাশ পাঠানোর ঘটনা ছিল।
অভিবাসন নিয়ে কাজ করা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) ২০১৭ সাল থেকে দেশে আসা ৫৪৮ নারী শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ ও করণীয় বিষয়ে একটি গবেষণা করেছে। ‘ডেথ অব ফিমেল মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এ গবেষণার প্রতিবেদন ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে সংস্থাটি। গবেষণায় সনদে থাকা মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, ৬৯ শতাংশ নারী শ্রমিকের ‘স্বাভাবিক’ ও ৩১ শতাংশের ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। এই নারীদের যে আসলেই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি তা বোঝা স্পষ্ট হচ্ছে দিন দিন। গত ৩ জুন সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন ১২ জন নারী। তাদের দাবি অসহয়নীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। গৃহকর্তার এই বিকৃত উল্লাস সহ্য করা দুঃসাধ্য ছিল। সৌদিফেরত এসব নারীরা জানান, যে মারধোর করত তা সহ্য করা যায় না!
সম্প্রতি এই ১২ নারীর দেশে ফেরত আসা এবং তাদের বর্ণনা অনুযায়ী বোঝায় যাচ্ছে, প্রাবসী নারীরা কতটা নির্যাতনের শিকার। তারা কিভাবে অসহায় হয়ে পড়ে একটু সুখের আশায় গিয়ে৷ গৃহকর্তার রোষে পড়ে তাদের জীবন পর্যন্ত শেষ হয়ো যাচ্ছে। তা উল্লেখিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্পষ্ট হয়েছে৷ তবে প্রবাসী নারী নির্যাতন রুখতে দেশ ও রাষ্ট্রের করণীয় কী! আর সাধারণ জনগণেরই বা কী করণীয় সেটা বিচার্য বিষয়।
গত ৩ জুন সৌদি ফেরত এসব নারীরা দেশে ফিরে যে অসহয়নীয় বর্ণনা দিয়েছেন তাতে তাদের প্রতি নির্যাতনের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এসব নারীরা জানিয়েছেন তারা ব্যাপক মারধোরের শিকার হয়েছেন। সহ্য করতে না পেরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। পরবর্তীকালে তারা পুলিশের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন এবং শেষপর্যন্ত ওই নারীসহ ১২ জন দেশে ফেরত আসেন। তারা এজেন্সির মাধ্যমে টাকা দিয়ে প্রবাসে কাজের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন। মাত্র ছয় মাস আগে সৌদিতে কাজ করতে যান। এর মধ্যেই তার জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে মালিকশ্রেণি।
প্রবাসে নারী নির্যাতন বন্ধের লক্ষে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা আবশ্যক। কারণ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতা তো আছেই তাছাড়া জনগণ যদি চোরায় পথে গিয়ে পড়ে সে দায় সরকারের ওপর চাপানো ঠিক নয়। কারণ দেশের বাইরে বৈধ পথে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আজকাল সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নির্যাতন এড়াতে প্রথমত বৈধ পথ অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। কোনো প্রকার দালাল বা অবৈধ বেসরকারি এজেন্সি, চক্রের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব খুঁইয়ে প্রবাসে পাড়ি জমানো থেকে বিরত থাকতে হবে। তানাহলে দেশের বাইরে যাওয়ার পর নারীদের দায়ভার সরকার বহন করতে ব্যর্থ হবেন।
কারণ সরকারি রেকর্ড এজেন্সি বা দালালের মাধ্যমে যাওয়া নারীদের সঠিক তথয়-উপাত্ত নথিভুক্ত থাকে না। বিধায় পরবর্তীকালে যদি অভিযোগ পায়ও তবে উদ্ধার কার্যে প্রবেশ করা সরকারের জন্য পীড়াদায়ক! কারণ যেখানে পুরোটাই অবৈধ পথে সৃষ্টি হয় সেখানে পরবর্তীকালে বৈধভবে পদক্ষেপ গ্রহণ কঠিন। তাই যেই নারীরা ভাগ্যন্নোয়নে বহির্বিশ্বে পাড়ি জমাতে চান তারা সরকারি বিধিনিষেধ মান্য করে এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। এর ফলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একটা জবাবদিহিতার জায়গা থাকে। তারা কূটনৈতিক সম্পর্কের জেরে দেশের নারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। তাই প্রবাসে নারী নির্যাতন কমাতে অবশ্যই বৈধ পথ অবলম্বন করা আবশ্যক। তবেই নারীরা ভালোভাবে কর্মে নিযুক্ত হতে সক্ষম হবেন।