রাবিতে র্যাগিং নিষিদ্ধ, অনুসরণযোগ্য সিদ্ধান্ত
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস শুরু হয়েছে। নবাগতদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে র্যাগিং। যদিও র্যাগ দেওয়াটা অনেকেই ভালো চোখে দেখেন যদি না সেটা শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে খারাপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু র্যাগিং প্রায়শই সহনশীল পর্যায়ে থাকে না। আর এই কারণেই অনেক স্টুডেন্ট মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
র্যাগিং অর্থ হলো পরিচিত হওয়া, তিরস্কার করা। র্যাগিংয়ের আভিধানিক অর্থ ‘রসিকতার নামে অত্যাচার করা’। আরও ভালো করে বললে, এর অর্থ দাঁড়ায় পরিচয় পর্ব। যেখানে পুরাতন স্টুডেন্টদের সঙ্গে সদ্য ভর্তি হওয়া স্টুডেন্টদের একটা সখ্য তৈরি হয়। একে অন্যকে জেনে নেয় ছোট্ট একটা আয়োজনের মাধ্যমে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও র্যাগিং; এই দুটো শব্দ বর্তমানে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বিভিন্ন মেডিক্যালেও এই চিত্র পরিলক্ষিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের মধ্যে এর চর্চা বিশেষভাবে চোখে পড়ে।
র্যাগিং সিস্টেমটা সাধারণত সিনিয়রদের কাছ থেকেই জুনিয়ররা পেয়ে থাকে। বিশেষ করে নিজ নিজ ডিপার্টমেন্ট থেকে এই র্যাগিং পেয়ে থাকে বেশি। তাই বলে সবাই র্যাগিং দিয়ে থাকে বিষয়টা, এমনও নয়। হাতেগোনা কয়েকজন মিলে মূলত র্যাগিং দিয়ে থাকে।
র্যাগিং অনেক ধরনের হয়ে থাকে। নাচ, গান, পরিচিতি পর্ব, রৌদ্রজ্বল ক্যাম্পাসে দৌড় দেওয়া, ম্যাচ বক্সের কাঠি দিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব মাপা, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শনসহ বিভিন্নভাবে র্যাগিং দিয়ে থাকে। এই র্যাগিং সিস্টেম অনেক সময় স্টুডেন্টদের শারীরিক র্যাগিং মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে।
কুমিল্লা ইউনিভার্সিটিতে ভাইবা দিতে গিয়েছি। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছি। খুব টেনশন কাজ করছে। ভেতরে শিক্ষক কী জিজ্ঞেস করবেন আর কিভাবে তা়দের ফেইস করবো, সেসব ভেবেই ঘেমে অস্থির। পাশে ভাই দাঁড়িয়ে আছে বোনকে সাহস জোগাতে। তাতে কি? বের হয়ে না আসা অব্দি টেনশন কাজ করবেই। আশেপাশে আরও কিছু স্টুডেন্ট অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার এই সময়টাতে এই ভার্সিটিরই তিন বড় ভাই এসে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, কোথা থেকে এসেছি, আমার পরীক্ষা কেমন হয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এত টেনশনে থেকেও সবগুলোর উত্তর দিচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল শরীরে কাঁপন সৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ এক বড় ভাই ধমকের সুরে বলে উঠলো আমি নাকি বেয়াদব। ভাইয়ারা সামনে আছে অথচ আমি সালাম দেইনি তাদের। কথাটা শোনামাত্রই সালাম দিয়ে দিলাম। আমার এমন আচমকা সালাম দেওয়া দেখে বড় ভাইয়েরা ভীষণ মজা পাচ্ছিলেন।
আমার তখন ভেতরে ভেতরে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সালাম দিয়ে দেওয়ায় তারা আর আমার মধ্যে বেয়াদবির কিছু পাননি। তাই পরবর্তী প্রশ্ন ছিল, আমার ভাইয়ের কাছে। ভাই তার বোনের গার্ডিয়ান হিসেবে এসেছে শুনে আর কিছু বলেনি। আমার পরীক্ষা যেন ভালো হয় তাই বলে চলে গেছে। এখন কথা হলো আমি যে ভাইবা দিতে গিয়েছি আদৌ সেখানকার স্টুডেন্ট হবো কি না বা ওখানে পড়বো কি না, সবকিছুই অজানা। এই অবস্থায় তাদের উচিত ছিলো আমাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়ার। সেটা না করলেও হ্যারেস করার কথা না অন্তত। তারা তা না করে আমার অবস্থা আরও খারাপ করে দিয়েছিলেন। আমি ওই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করিনি। কিন্তু ওখানকার র্যাগিং আমাকেও ছাড়েনি।
বাংলাদেশে স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ‘জাবির গণরুমে রাতভর র্যাগিংয়ের অভিযোগ’ শীরোনামে একটি প্রতিবেদন ২০১৮ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরে ছাপা হয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল জাবির আবাসিক হলের গণরুমে থাকা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা রাতভর র্যাগিং নামক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মূলত সিট সংকটের কারণে গণরুমে থাকা এসব শিক্ষার্থী প্রথম দিন থেকেই র্যাগিংয়ের শিকান হন। সিনিয়র শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে করেন র্যাগিংয়ের নামে এমন দুর্ব্যবহার। তারা আদব-কায়দা শেখানোর নামে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন করেন। সিনিয়রকে সালাম না দিলে কান ধরে উঠবোস করতে হয়। শীতের রাতে খালি গায়ে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা এমনকি ঠান্ডা পানিতে ডুব পর্যন্ত দিতে হয় তাদের।
এমন আচরণ পেয়ে অনেকই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো অতিবাহিত করে। তারাও একসময় অপেক্ষা করে সিনিয়র হওয়ার। যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে জুনিয়রদের ওপর। যদিও এই চিন্তা কখনোই কাম্য নয়।
২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি যুগান্তরে আরেকটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। যেখানে, ‘র্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থী ছাড়লেন রাবির ক্যাম্পাস’ নামে ভয়ানক এক তথ্য ছাপা হয়েছিল। ফাহাদ বিন ইসমাঈল নামের শিক্ষার্থী ‘বিদায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’ লিখে তার ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন।
র্যাগিং বাংলাদেশের জন্য কখনোই সুফল বয়ে আনবে না। শিক্ষার্থীদের স্মার্ট বানানোর নামে মূলত মানসিক বিকারগস্ত হিসেবে তৈরি করে চলেছে তথাকথিত সিস্টেমকে প্রাধান্য দেওয়া অল্প কিছু সিনিয়র শিক্ষার্থী।
র্যাগিং একটি সামাজিক ব্যাধি। এটা একটা ঘৃণ্য আচরণ, যা একজন ব্যক্তির শারীরিক-মানসিক ক্ষতি হতে পারে। র্যাগিং নাগরিক অধিকার পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাবিতে র্যাগিং সিস্টেম বন্ধ হওয়ার ফলে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠুক শিক্ষাদীক্ষায় স্মার্ট। আদব-কায়দা শিখুক সুন্দর মানসিকতার মানুষদের সঙ্গে থেকে। যেখানে রসিকতার নামে যেন অত্যাচারিত হতে না হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থী বাঁচুক র্যাগিংবিহীন এক সাম্রাজ্যে। যেখানে সিনিয়রদের দেখলে জুনিয়ররা ভয় না পেয়ে ভালোবাসকে শিখবে। র্যাগিং সিস্টেম কখনোই জাতির কল্যাণ বয়ে আনবে না। পরিচিত হওয়ার আরও অনেক কৌশল ও ধাপ আছে। র্যাগিংয়ের মাধ্যমে পরিচিত না হওয়া একজন শিক্ষার্থী সব দিক থেকেই সুফল বয়ে আনবে।