Skip to content

২৪শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ৮ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংসারগুলো ভাঙছে কেন?

বাংলাদেশের নামকরা গায়ক ও অভিনেতা তাহসান খান ও আরেক নামকরা অভিনেত্রী রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। একসময়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক থাকলেও হঠাৎই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন এই দুই তারকা। সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত কয়েকটি বিবাহবিচ্ছেদের কথা যদি তালিকা করা হয়। শুরুর দিকে থাকবে এই দম্পতির নাম। সাধারণ জনগণের সে কি উৎকণ্ঠা। এক একজনের মনে হাজারো প্রশ্ন। তাদের সংসার কেন ভাঙলো , কার দোষ, কিভাবে হলো, উত্তর খুঁজতে মরিয়া সব।

সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘তারকাদের নাকি বিবাহবিচ্ছেদ বেশি হয়।’ হলিউড থেকে বলিউড, টলিউড কিংবা ঢালিউড চর্চার ঊর্ধ্বে নয় কেউ। কোনো তারকার নতুন বিয়ে হলে মানুষ ধরেই নেয়, বছর না ঘুরতেই বিচ্ছেদের খবর পাওয়া যাবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটছেও তাই। তবে সবক্ষেত্রে ঘটছে না। তারকাদের ঘর ভাঙার গল্প আলোচনায় আসলেও সাধারণ জনগণের ঘর ভাঙার আওয়াজ বেশি দূর পৌঁছায় না। আজকাল ডিভোর্স কিংবা বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ আমাদের নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অতি আধুনিক মনোভাব ও জীবনযাপন।

তারকাদের গল্প দিয়ে শুরু করার কারণ আমরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে ওস্তাদ। অন্যদের জীবন নিয়ে চর্চা হচ্ছে দেখলে সেদিকে আমাদের আগ্রহ বাড়ে। তবে এবার পুরো সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ কিভাবে শেকড় বিস্তৃত করছে তা দেখার পালা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, কয়েক বছর ধরে তালাকের প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে তালাক বেশি হচ্ছে। ২০১৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত বিবিএসের দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তালাকের ঘটনা বেড়েছে ১৭ শতাংশ। গত বছর ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রতি ১ হাজার নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ১ দশমিক ৪টি তালাকের ঘটনা ঘটে।

আবার করোনা মহামারীর সময় এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছ। করোনার শুরুর বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বিশেষ করে ঢাকায় তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছিলো কয়েকগুণ। এ বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ঢাকায় বিবাহবিচ্ছেদ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে দৈনিক ৩৯টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে, অর্থাৎ প্রতি ৩৭ মিনিটে একটি তালাক হয়েছে।

গবেষণা বলছে সবচেয়ে বেশি বি বাহবিচ্ছেদ হচ্ছে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে। এখানে শুধু শিক্ষাকে ভিলেন বানানো একদমই উচিৎ নয়। কারণ বহু শিক্ষিত যৌথ পরিবারও আমাদের সমাজে এখনও আছে। এখানে অনেকাংশে দোষ যায় অতি আধুনিক মানসিকতার দিকে। যার কারণে দিনে দিনে আমাদের মূল্যবোধ হারাচ্ছে। তার মানে এই নয় যারা বিবাহবিচ্ছেদ করছেন তাদের প্রত্যেকের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে।

প্রতিনিয়ত যৌতুকের জন্য স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চেয়ে বিচ্ছেদ করে নেয়া ঢের ভালো। এমন বহু দিক রয়েছে যেসব ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদে দোষের কিছু খুঁজে পাই না বরং মনে হয় বিচ্ছেদ এখানে বাঞ্ছনীয়। তবে মাঝেমধ্যে কিছু খবর এমনও হয়, ‘গয়না কিনে না দেয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ, বৌ কেন চাকরি ছাড়ছেনা তাই বিচ্ছেদ ইত্যাদি।’ এখানেই মূলত সমাজের অতি আধুনিকায়নকে দোষ দিচ্ছি। আজকাল অনেক নারীরাই ভাবেন আমি স্বাবলম্বী, নিজের সন্তানকে একা বড় করতে পারবো, তাই অনায়াসে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কিন্তু সন্তানের বেড়ে ওঠায় একটি সুস্থ পরিবেশ কিংবা পরিবার যে কত জরুরী সে খেয়াল কারো থাকেনা।

এক্ষেত্রে প্রগতিশীল অনেকেই মনে করেন তিক্ত সম্পর্কে থাকার চেয়ে বিচ্ছেদ কয়েকগুণ ভালো। একসময় নারীরা বহু নির্যাতন সহ্য করেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। এর পেছনে কারণ ছিলো বেশিরভাগ নারীরাই স্বনির্ভর ছিলেন না, আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে ধরাবাঁধা কিছু নিয়ম দেয়া আছে তা ভাঙার সাহস কারো ছিলো না। একা নারী বসবাস করবে এ ধারণা আগের দিনে মানুষের কল্পনাতেও জায়গা পেতো না। কিন্তু ধীরে ধীরে নারীরা আত্মনির্ভরশীল হচ্ছে এবং তিক্ত সম্পর্কগুলো থেকে বের হয়ে আসার সাহস জন্মাচ্ছে যা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক।

এছাড়া অনেক দম্পতি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে, নিজেদের সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ করেন। একে অপরের প্রতি সম্মান যাতে বজায় থাকে, সম্পর্কে যাতে তিক্ততা বৃদ্ধি না পায় সে চেষ্টা করেন তারা। বাংলাদেশের একসময়ের হার্টথ্রোব অভিনেত্রী ছিলেন সুবর্ণা মুস্তফা। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তখনকার সময়ের স্বনামধন্য অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর সাথে। একসময়ে তাদের সম্পর্ক ছিলো হিংসে করার মত। কিন্তু তারাও পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেন আলাদা হওয়ার। বিবাহবিচ্ছেদের বহুবছর পর সুবর্ণা মুস্তফা বলেন, তারা চাননি একে অপরের প্রতি ঘৃণা তৈরি করতে, তাই দুজন দুজনের প্রতি সম্মান রেখে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।

এসব দিক দিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের ইতিবাচক দিক টানা যেতেই পারে। কিন্তু কতটা? আগেই বলেছিলাম, স্বামীর হাতে নির্যাতন সহ্য না করে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া, পছন্দের গয়না কিনে না দেয়ায় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া এক নয়। সিঙ্গেল ফাদার ও সিঙ্গেল মাদারের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিভোর্সের পর বাচ্চাকে বাবা রাখবেন নাকি মা এই নিয়ে কোর্টে দৌড়চ্ছেন রোজ। কিন্তু বাচ্চার উপর কি মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে সে খেয়াল রাখছে কজন।

পরিবার শুধু চারদেয়ালের মধ্যে বসবাস করা নয়। হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার নামই পরিবার। আমাদের উপমহাদেশে পরিবার মানে শত ঝড়ঝাপটা একসাথে সামলানো। কথায় কথায় বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তা শুধু দুজন মানুষের প্রতি না পরিবার বা তাদের সাথে সম্পর্কিত আরও বেশ কয়েকজন মানুষের উপর পরবে। কিন্তু এসব দূরদর্শী চিন্তা ভাবনা না করে হঠকারিতা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা বোধগম্য নয়। ঝগড়া করে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত না নিয়ে, খোলামেলা বিচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা না করে কিভাবে সমস্যার সমাধান করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করা যায়।

কিন্তু আজকাল অতি আধুনিক মানুষজন ভাবছে একদিন বনিবনা হচ্ছে না মানে কোনোদিনও হবে না। পাশের বাসার একজন নারী দিব্যি মেয়েকে নিয়ে একা সংসার করতে পারলে আমি কেন পারবো না। পছন্দের তারকা বিচ্ছেদ নিয়ে দু’একটা মোটিভেশনাল বক্তব্য দিলো তো ওমনি পান থেকে চুন খসলে বিচ্ছেদের চিন্তা মাথায় ঢুকে গেলো। আবার আজকাল সিনেমা নাটকের কাহিনী গুলোতেও ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে এতো বেশি বিচ্ছেদের গল্প দেয়া হচ্ছে যা মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে।

এভাবে চলতে থাকলে আমাদের উপমহাদেশে পারিবারিক সম্প্রীতি বলতে যে একটা জিনিস আছে তা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনিতেও যৌথ পরিবার ভেঙে দিনের পর দিন একক পরিবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার উপর ছোটোখাটো সংসার ভাঙনের গল্পগুলো আশার আলো দেখাচ্ছে না। আজকের শিশুদের জন্য সুন্দর একটি সমাজ তৈরির জন্য সংসার ভাঙনের গল্পগুলোর সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ