মেঘের দেশে ঘুরে আসুন…
১
উদাসী মনে বেদুইন টান থাকতেই পারে। সেই মেঘবালিকার গল্পটুকু করতে চাচ্ছেন তবু বুঝতে পারছেন সেখানে আপনার অস্তিত্বের ঠাঁই রীতিমত শূন্য, তখন মনে হবে এবার কোথাও ডুব দিয়ে আসি। শান্তির খোঁজে তখন আর কোথায় ঘুরবেন? ভুটানে যেতে পারেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সুন্দর এই রাষ্ট্র আপনায় এক দণ্ড শান্তির খোঁজ দেবে নিশ্চিত। এমনিতেই মেঘবালিকার অবহেলা ও প্রকৃতির ভ্যাপসা গরমে টেকা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। শীতলতায় অবগাহন করতে চাইলে যেতে হবে পাহাড়ি ভুটানে। এক মায়াবী দেশ ভুটান। কারো কারো চোখে রহস্যের ছায়া নিয়েও আসে এই দেশটি। সেই রহস্যকে জিঁইয়ে রাখতেই কোলে ঠাই দিয়ে রেখেছে হিমালয়। হিমালয়ের কোলে থাকা রাষ্ট্রটিতে অবশ্য হিমালয়ের চোখ রাঙানোর ভয় কম। বরং যেন মাতৃত্বের এক সুন্দর রূপ সেখানে দৃশ্যমান হবে কাছে গেলে।
বাংলাদেশ থেকে ভুটানে যাওয়ার দুটি উপায় আছে। একটি বেশ সহজ – আপনি সরাসরি বিমানে করে চলে যাবেন। আরেকটি হলো সড়কপথে। জ্বি, অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাকে গালমন্দও করার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ ও ভুটানের দূরত্ব কম হওয়ায় সড়কপথেও যাওয়া যায় দেশটিতে। তবে সেজন্যে ভারতের ট্রানজিট ভিসা সংগ্রহ করতে হবে। কারণ ভারত হয়েই ভুটানে যেতে পারবেন আপনি। সড়ক পথে সচরাচর কেউ ভ্রমণ করেন না। এতে খরচ বেড়ে যায়। তবে ভ্রমণের উত্তেজনা বাড়াতে সড়কপথের জুড়ি মেলা ভার।
ভুটানে গেলেই চলে যাবেন ফুন্টশেলিং-এ। এখানে এক স্নিগ্ধ শীতলতা আপনায় স্বাগত জানাবে। মনে করিয়ে দেবে, হিমালয় খুব কাছেই। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি কিংবা মেঘবালিকাকে দূরে রাখার সমস্ত ভাবনা কিছুটা কেটে যেতে পারে। ভারি সুন্দর এই শহরে একা একা ঘুরে বেড়ান। অজস্র ছোট বড় রেস্তোরা ও ক্যাফে এখানে। রকমারি দোকান-পাট আর মানুষের প্রাণোচ্ছলতা। শহরের সাথেই আপনার গল্প হবে। শহরের মধ্যস্থলে দেখতে পাবেন এক অপরূপ গুম্ফা মন্দির। মন্দিরটির নাম জ্যাংটো লের লাখাং। ১৯৯০ সালে দাশো আকু টঙ্গম নামে এক প্রখ্যাত সুরকার মন্দিরটি গড়ে তুলেছিলেন। এর স্থাপত্য দেখে নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম। ফ্যান্টাসি মুভিতেই ওমন স্থাপনা দেখা যেতে পারে। বাস্তবেও? এই মন্দিরেই আছে বৌদ্ধদের গুরুদেবের বিভিন্ন ধরণের মূর্তি। ফুন্টশোলিং এ গেলে নিজের শেকড়ও কিছুটা পাবেন। এই মন্দিরের এক অংশে সমাহিত আছেন একজন ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম প্রচারক। তিনি তিব্বতে ধর্ম প্রচার করতেন এবং খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তারই আটটি অভিব্যক্ত মূর্তি এখানে। তাতে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পাশাপাশি ভক্তদের আনাগোনাও বেড়েছে।
মেঘবালিকা দূরে। তবে তার ডাক হয়তো মন্দির থেকে বের হওয়ার পরেও আপনার কাছে আসতে পারে। শুরু হতে পারে তীব্র দমকা হাওয়া। আকাশে দেখা দিতে পারে কালো মেঘের ঘনঘটা। নামবে মুষল ধারায় বৃষ্টি। এমন সময়ে ঢুকে পড়ুন মোমোর কোনো দোকানে। ভুটিয়া কোনো নারী মিষ্টি হাসি দিয়ে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে। চিকেন মোমোর সুনাম এখানে বেশ। সেটিই অর্ডার করুন। পাহাড়ি বৃষ্টি কিছুক্ষণ পরই থেমে যাবে। এই বৃষ্টি থামতেই মেঘের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার পায়ে হেটে শহর ঘুরে দেখুন। চারদিকে ব্যস্ততা, পসরার সমাহার। এবার বিশ্রাম নিতেই হবে। পাহাড়ে হুট করে গেলে বেশি ঘুরোঘুরি করতেই নেই। ফিরে চলুন হোটেলে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নেমে আসতে শুরু করলে জানালার পাশে বসে দেখুন শহরটিকে। পাহাড়ের চড়াই উতরাইয়ে জ্বলে উঠবে অজস্র বৈদ্যুতিক আলো। বারান্দা থেকে মনে হবে অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে পাহাড়ের গায়ে। মেঘবালিকা যেমন আপনায় মুছে দিচ্ছে, আপনি এবার তাকে নিয়ে ভাবুন। তার গল্প করুন।
২
পরেরদিন যেতে হবে ইমিগ্রেশন অফিসে। ফুন্টশোলিং এ ইমিগ্রেশনের বালাই না থাকলেও ভুটানের অন্য জায়গায় আছে। এই সময়েই একজন ট্যুর গাইড চলে আসবে। ভুটানে আপনার একজন রেজিস্টার্ড ট্যুর গাইড লাগবেই। সঙ্গে থাকবে ড্রাইভার। পুরো সফরে এবার আপনি দুই স্থানীয় বাসিন্দাকে পাবেন সফরসঙ্গী হিসেবে। এখানকার মানুষের হাসিখুশি ভাব দেখে আপনি অবাক হবেন। জানা নেই কি? ভুটানকে বলা হয় ‘কিংডম অব হ্যাপিনেস’। কারণ এখানকার মানুষ জিডিপি নয় বরং গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস এ বিশ্বাসী। অদ্ভুত তাই না?
ফুটশোলিং থেকে আপনার গন্তব্য পারোতে। এই সফরটি বড্ড মনোরম। ছয় ঘণ্টার যাত্রাপথ খুব ক্লান্তিকর মনে হবে না। রাস্তার ধারে কিংবা পথে যে পাহাড়ের সঙ্গে দেখা হবে তাদের গায়ে অজস্র নাম না জানা ফুল দেখে বারবার আপনি পেছনে ফেলে যাওয়া ফুলের দিকে পিছু ফিরে তাকাবেন। মেঘবালিকার মাথায় কোন ফুল মানাবে সেটিও ভাববেন। রাস্তায় গাড়ি থামলে বাটার চা খেয়ে নেবেন। এটি ভুটানের বিশেষত্ব। চা পাতার সঙ্গে দুধ, বাটার ও লবণ মিশিয়ে বানানো হয়। চিনির বদলে লবণ দেওয়ার পরেও দারুণ লাগে খেতে। যাত্রাপথে ড্রাইভার হয়তো ভুটানি লোকসঙ্গীত বাজাবেন। সেগুলো শুনতেও দারুণ লাগবে। বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ হবেন। স্রোতস্বিনী ঝরনাকে দেখে মনে হবে কোনও নদী বক্ষে মিলিত হওয়ার আকুল তাগিদ। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে নিজের অজান্তেই বুকভরে শ্বাস নিন। বিশুদ্ধ অক্সিজেন। এখানকার রাস্তা বড্ড ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আপনার মনে আতঙ্ক কাজই করবে না। কারণ ড্রাইভাররা এখানে বেশ দক্ষ।
পাহাড়ের পথেও দেখবেন বহু রঙিন পতাকা। গাইডকে জিগ্যেস করে জেনে নিতে পারেন সেগুলো কি। অনেকে কৌতূহল মেটানোর কথা এখন ভাবেন না। তাই আমিই বলে দেই, এগুলোকে প্রেয়ার ফ্ল্যাগ বলে। বৌদ্ধদের ধারণা পতাকাগুলো হাওয়ায় শান্তি, সমবেদনা, শক্তি, জ্ঞান ও মঙ্গলকামনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।
পারোতে এলে আপনার আবার মেঘবালিকার কথা মনে হবে। জায়গাটা শপিং এর জন্যে দারুণ। মেঘবালিকা থাকলে ভালোই হতো। স্থানীয় বাজারে ঘুরে দেখে নিন। হস্তশিল্পের কাজের কদর আছে এখানে। ভুটানে পোশাক নিয়ে বিধিনিষেধ তেমন নেই। তবে প্রশাসনিক কিংবা ধার্মিক কেন্দ্রে প্রথাগত পোশাক পরতে হয়। ভুটানি মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘কিরা’ আর ছেলেদের পোশাক ‘ঘো’। প্রায় দু’মাস হাতে বুনতে হয় কাপড়গুলো। বুঝতেই পারছেন, দাম অনেক। শহরে পর্যটকদের জন্যেই আছে সুন্দর সুন্দর রেস্তোরা। রাতের খাবার খাঁটি ভুটানিজ রেস্তোরায় সাড়ুন। এখানকার ‘এমা দাৎসী’ ও ‘কেওয়া দাৎশী’ খেয়ে দেখতে পারেন। ভুটানিরা ঝাল খেতে ভালোবাসে। সেজন্যে ভুটানের খাবার আপনার ভালো লাগবে।
তৃতীয় দিন ঘুরে আসুন তা জং নামক কেল্লায়। এখানে প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মাংদে নদীর পাড়ে অবস্থিত কেল্লাটি তিব্বতকে ভারতের হাত থেকে রক্ষার জন্যে বানানো হয়। ১৭ শতকে একে যাদুঘর বানানো হয়। গোলাকৃতির কেল্লাটি নাকি শুধু পাথর ও কাঠ দিয়ে নির্মিত। এতে নাকি পেরেক নেই। অথচ এত বছর পরেও কেমন অক্ষত আছে। এই যাদুঘরে অনেক বহু পুরোনো সব পুরাতত্ত্ব দেখে মুগ্ধ হবেন আপনি/ যাদুঘর থেকে কিছু দুরেই পং জং নামে সুদৃশ্য কাঠের সেতু পাবেন। সেতুতে হাটতে হাটতে চারপাশের অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ না হয়ে কি পারা যায়? সহজ সরল জীবন-যাপন নজর সম্ভবত ভুটানেই কাড়তে পারে।
ভুটানে ভ্রমণের পাল্লা শেষ করবেন টাইগার নেস্ট মনেস্ট্রির জন্য। এই অনবদ্য পর্যটন কেন্দ্র বৌদ্ধ ধার্মিক কেন্দ্র হিসেবে ১৬৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। গুহাকে কেন্দ্র করে বানানো এই জায়গাটি অক্ষত আছে।
অন্তত ভুটান যাত্রার প্রাথমিক ধাক্কা কাটলো। তারপর যদি মূল ভুটানে যেতে চান সেটি থিম্পু। তবে সেই গল্প অন্যদিনের জন্যে। আজ মেঘবালিকার থেকে ডুব দেওয়ার জন্যেই পারোর গল্প জুড়ে দিয়েছি। আরেকদিন নাহয় মূল ভুটানের ভ্রমণে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা দেবো।
অনন্যা/এআই