Skip to content

২৫শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৯ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এক বিজয়ালক্ষ্মী নারী

সাধারণের বেশে অসাধারণ, ঘরে থেকেও পুরো দেশের মনে বাস করা, বিপদ জেনেও স্বামীকে সামনে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করা এক দেশপ্রেমিক নারীর জন্মদিন আজ। তিনি হলেন আমাদের সকলের প্রিয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি আমাদের প্রিয়নেতা বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী। কেবল স্বামীর কারণে নয়, নিজের কোমলতা, ভালোবাসা, জ্ঞান, ধৈর্য ও শক্তি দিয়ে বাংলার মানুষের মণিকোঠায় শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে জায়গা করে নিয়েছেন।

 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতার ‘প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী’ লাইনেরই এক বহিঃপ্রকাশ হলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। আজীবন ছায়ার মতো পাশে থেকে স্বামী শেখ মুজিবকে অধিষ্ঠিত করেছেন হিমালয়সম আসনে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রেরণা দানের পাশাপাশি এদেশের সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। স্বাধীন সার্বভৌম দেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে দীর্ঘ ২৪ বছর লড়াই সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপ বাস্তবায়নে জাতির পিতার নেপথ্যে শক্তি, সাহস ও বিচক্ষণ পরামর্শক হয়ে ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

 

বঙ্গমাতা এমন একজন মহিলা, যার স্বামীর জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অফিসাররা ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে ফাঁসি দিতে চায়। অথচ তবুও তিনি তার সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন। এখান থেকেই বোঝা যায় তিনি কত বড় ত্যাগী মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৪ বার কারাবরণ-কালে ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তায় স্থির এবং অবিচল থেকে বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন  তিনি। শুরু থেকেই দূরদর্শিতার  পরিচয় দিয়ে এসেছেন এই মহীয়সী নারী।

 

১৯৩০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গমাতা বেগম মুজিব। ফুলের মত গায়ের রং ছিল বলে মা ডাকতেন রেণু। কিন্তু দুর্ভাগ্য রেণুর, মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। দাদার কাছেই বড় হচ্ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন রেণুর বিয়ে হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। পাঁচ বছর বয়সে মা কে হারানোর পর শ্বাশুড়ি সায়েরা খাতুন তাঁকে বুকে টেনে নেন। ছোটবেলা থেকেই রেণু ছিলেন অত্যন্ত নম্র, শান্ত ও অসীম ধৈর্য্যর অধিকারী। সকল কাজেই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতেন। পারিবারিক নিয়মনীতি, শিক্ষা ও ঘরের সকল কাজ রপ্ত করেছিলেন অত্যন্ত নিপুণতার সাথে। 

 

এদিকে বিয়ে হলেও শেখ মুজিবের এন্ট্রান্স পাসের পর মূলত তাদের সংসার জীবন শুরু হয়। পড়াশোনায় বেগম ফজিলাতুন্নেছা বড় ডিগ্রিধারী ছিলেন না, কিন্তু মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন অনেকের চেয়ে বড় হৃদয়ের অধিকারী। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। সেখানেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। আর তখন বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে সময় কাটতো বেগম ফজিলাতুন্নেছার। বেগম মুজিব ছিলেন একজন অত্যন্ত রুচিশীল মানুষ। যার জ্ঞান ছিল অত্যন্ত গভীর। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হয়তো তার ছিল না। কিন্তু তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। এর মধ্যদিয়ে দেশের রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে তার একটি সুস্পষ্ট ধারণা জন্ম হয়েছিল। চিন্তা-চেতনা ও কর্মে ছিলেন খাঁটি বাঙালি নারী। একজন বাঙালি গৃহবধূ হিসেবে তিনি পান খেতেন। পান ছিল তার খুবই প্রিয়। 

 

দেশ বিভাগের পূর্বে ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময় বঙ্গমাতা নিজে অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও স্বামীকে দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় কাজ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। চিঠি লিখে দেশের কাজে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছেন এইভাবে, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হবার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্য জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর আমার ভার ছেড়ে দিন।’ বয়সের হিসেবে বঙ্গমাতা তখনও কিশোরী। একজন কিশোরী হয়েও দেশের জন্য এতো বড় ত্যাগের মানসিকতা তার বরাবরই ছিলো।

 

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করা হয়। এক বছরেরও বেশি সময় তিনি বন্দী ছিলেন। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এই পুরো সময়টা রাজবন্দীদের পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছেন, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে ছাত্র জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে এই ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করেছেন। এরপর ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুকে জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কারাগারের যাতনা সহ্য করতে হয়েছে। কারাবন্দী অবস্থায় অনশন ধর্মঘট করার কারণে মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বঙ্গবন্ধুকে সকল দুঃখ ও নির্যাতন বরণের শক্তি, সাহস, ধৈর্য্য, সহ্য ও প্রেরণা দিয়েছেন এই সংগ্রামী নারী। 

 

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে একাত্তরের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের ঠিক আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যখন কী বলবেন তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন তখন তাকে সাহস যুগিয়েছিলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছাই। সেদিন বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছো, তুমি জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছো। তুমি জানো যে এ দেশের মানুষের জন্য কী চাই, তোমার থেকে বেশি কেউ জানে না। তোমার মনে যে কথা আসবে, তুমি শুধু সেই কথাই বলবে, কারো কথা শুনতে হবে না।’ 

 

এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সে সময় গ্রেপ্তার হন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবও। তখন তার সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। তাদের বন্দি রাখা হয় ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাসায়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গৃহবন্দী থেকে এবং পাকিস্তানে কারাবন্দী স্বামীর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গভীর অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা সত্ত্বেও তিনি সীমাহীন ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। পরবর্তী সময়ে শেখ জামাল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পরের দিন যৌথবাহিনী তাদের সেখান থেকে মুক্ত করে।

 

দেশের দুঃসময়ে বেগম মুজিব শুধু পরিবারের দেখাশোনাই করেননি, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে বেগবান রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বেগম মুজিব প্রতি মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ লেখার ক্ষেত্রেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল তাঁর। প্রতিবার জেলখানায় দেখা করার সময় বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করতেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ শুনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের তা জানাতেন বেগম মুজিব। অন্যদিকে কারাগারে সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেও সহযোগিতা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় নিজের ঘরের আসবাবপত্র, অলঙ্কার বিক্রি করেও দল ও নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা। 

 

বঙ্গমাতা বেগম মুজিব কেবল একজন গৃহবধূ ছিলেন না, ছিলেন রাজনীতিবিদ, ছিলেন সুযোগ্য সহধর্মিণী, ছিলেন একজন রাজনৈতিকযোদ্ধা। ছিলেন একজন ধৈর্য্যশীল মাতা, ছিলেন একজন যোগ্য সহযোগী। বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব হতে বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত নিয়ে যেতে যদি কারও একক সর্বোচ্চ অবদান থেকে থাকে, তিনি হচ্ছেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। একদিকে সন্তানদের সামলে রাখা, অন্যদিকে কারাগারে গিয়ে স্বামীর মনোবল দৃঢ় করা কিংবা আইনজীবীর কাছে মামলার খোঁজখবর করা—সবকিছু করেছেন এক হাতে। 

 

বেগম মুজিব ছিলেন একজন রত্নগর্ভা নারী। তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত ও আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাঁর দুই সুপুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল ছিলেন রণাঙ্গনের অকুতোভয় বীরযোদ্ধা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও একজন বিদুষী নারী এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক। এসবই তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হয়েও ৩২ নম্বরের বাড়িতে তিনি থেকেছেন। গণভবনে যাননি। প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে যেভাবে দেখার প্রত্যাশা করা হয় তার ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমৃত্যু স্বামীর পাশে থেকে একজন যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে দেশ ও জাতি গঠনে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা' এ দুটি গ্রন্থে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নানা রকম স্মৃতিচারণ রয়েছে। 

 

সংসার জীবন তারপর রাজনৈতিক জীবনের পরে মৃত্যুতেও স্বামীর সহযাত্রী হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। এই দিন  স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে স্বামী-পুত্র, পুত্রবধূসহ নির্মমভাবে শহীদ হন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনিরা তাঁকে বলেছিল, ‘আপনি চলেন’। তিনি বললেন, ‘কোথাও তো যাবনা। ওনাকে খুন করেছ, আমাকেও শেষ করে দাও। আমি এখান থেকে এক পাও নড়বো না।’ তিনি খুনিদের কাছে জীবন ভিক্ষা চাননি। বীরের মত বুক পেতে দিয়েছিলেন বুলেটের সামনে। ৯১তম জন্মদিনে বাংলার এই মহীয়সী নারীর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ