মেনোরেজিয়া: একটি নীরব ঘাতক
মেয়েদের কাছে খুবই পরিচিত একটি সমস্যা মেনোরেজিয়া। অনেকেই এই রোগের নাম হয়তো জানেন না, কিন্তু এ সমস্যায় ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরেই। অনেকে আবার এই বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা পান, আর ডাক্তারের কাছে এ ধরনের রোগ নিয়ে যাওয়ার অনীহা তো আছেই। মাসিক চলাকালে স্বাভাবিকের চাইতে বেশি রক্তপাত হলে তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মেনোরেজিয়া বা অতি রক্তস্রাব বলা হয়। ২০-৪০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট বলছে, ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ নারী মনে করেন মাসিক কালীন সময়ে তারা অতি রক্তস্রাবজনিত সমস্যার ভোগেন। পাশাপাশি এ সময় প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কারে নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা। শতকরা ৯৫ ভাগ নারীই তাদের মাসিককালে নানাবিধ কুসংস্কারের শিকার হন। বিশেষত, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করাকে কেন্দ্র করে। ফলে সামাজিক কুসংস্কার নারীর মেনোরেজিয়ায় হওয়া শারীরিক ক্ষয়কে আরও বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়, এ দেশের ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী প্রতি তিনজনের একজন নারী প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পায় না।
বিভিন্ন কারণে মেনোরোজিয়া নামের এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। হরমোন জনিত সমস্যা, জরায়ুতে টিউমার বা ক্যানসার, রক্তে কোনো সমস্যা, জরায়ু বা ডিম্বনালিতে জীবাণু সংক্রমণ, জননাঙ্গে সিস্ট থাকা, ওভারিয়ান ক্যানসার, কিডনির অসুখ বা যকৃতের অসুখ, মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তাসহ নানা কারণে এই রোগের সূত্রপাত হতে পারে। তবে মজার বিষয় অনেকেই হয়তো সচেতনতার অভাবে জানেনই না, যে রোগে তারা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন বা যে কষ্ট তারা অনেকদিন ধরে করে আসছে, সেটির আসলে চিকিৎসা রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ঠিক কতখানি রক্ত গেলে তাকে 'অতি রক্তস্রাব' বলবেন? একজন নারীর সাধারণত প্রতিটি ঋতুচক্রে গড়ে ৩০-৪০ মিলিলিটার রক্ত বেরোয়। কিন্তু যখন ৮০ মিলিলিটার বা তার থেকে বেশি রক্তপাত হয় তখনই ভারী রক্তক্ষরণ-সহ অতিরিক্ত ঋতুস্রাব বা 'হেভি মেনস্ট্রুয়াল ব্লিডিং' বলা হয়। তবে মিলিলিটার দিয়ে মাপ বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। যখন প্রতি দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা পর পর ন্যাপকিন বদলাতে হয় তাহলে বুঝতে হবে সেটি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা অতি ঋতুস্রাব। এ ক্ষেত্রে ঋতুকালীন অবস্থা চারদিনের বেশি, আবার কখনো সাতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এছাড়াও এই সমস্যার কিছু নিয়মিত লক্ষণ দেখা যায়, যেমন
– প্রতি ঘণ্টায় একটি বা তার বেশি স্যানিটারি প্যাড লাগলে।
– ডাবল প্যাড ব্যবহার করতে হলে।
– ব্লাড ক্লটের পরিমাণ বেশি দেখা গেলে (জমাট বাঁধা/রক্তের চাকা)।
– এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রক্তপাত হলে।
– অতিরিক্ত রক্তপাত যা আপনার প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজ কর্মকে বাঁধাগ্রস্ত করে।
– অতিরিক্ত ক্লান্ত বা দুর্বল লাগা, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, মাথা ব্যথা এমন কী শ্বাসকষ্ট পর্যন্ত শুরু হতে পারে। এই লক্ষণগুলো সাধারণত রক্তশূণ্যতার জন্য হয়।
সচেতনতা, যথাযথ জ্ঞান, চিকিৎসা ইত্যাদির অভাবে মেনোরেজিয়ার প্রভাবে একজন নারীর দীর্ঘকালীন বিভিন্ন যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক অবস্থার সম্মুখীন হন। এর ফলে শরীরে ব্যথা, খিটখিটে মেজাজ, মাথা ঘোরা, চোখে ঝাপসা দেখা, হরমোনের তারতম্য জনিত অস্বস্তি, ক্লান্তি ইত্যাদি সমস্যার উদ্ভব ঘটে। শুধু তাই নয়, একই সাথে অবনতি ঘটে মানসিক স্বাস্থ্যেরও। মেনোরেজিয়াজনিত সমস্যায় ভোগা একজন নারী প্রায় সবসময় বিষণ্ণতায় ভোগেন যার প্রভাব পড়ে তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে। অন্যদিকে অধিক রক্তপাতে অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৪২ ভাগ মেয়ে বা নারী আয়রন বা রক্তে লৌহ-স্বল্পতায় ভুগছেন। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্যে চারজন অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতার শিকার, যা পরে আরও জটিল সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এমনকি মাতৃমৃত্যুর কারণও হতে পারে।
মাসিক ঋতুস্রাব মেয়েদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণও বটে। মাসিক নিয়মিত ও সঠিকভাবে হওয়ার অর্থ হচ্ছে সে নারী সন্তান ধারণে সক্ষম। মেয়েদের এবং মায়েদের মধ্যে অনেক ভুল ধারনা মাসিক নিয়ে বিদ্যমান। এক সময়ে মাসিককে অপবিত্র ও নোংরা বলে মনে করা হত। একসময় বেশি মাসিক হলে নোংরা রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হত। কিন্তু এই ধারণা ভুল। এরকম হলে বরং রক্তাল্পতা হয়ে নানা সমস্যা হয়। তাই এমন হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ বের করে চিকিৎসা নিতে হবে। সবাই সচেতন হলে এই সমস্যা অনেক কমে আসবে।