Skip to content

২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাউন্ডারিই বাধা বাংলাদেশের মেয়েদের

পাওয়ার হিটিংয়ের টি-টোয়েন্টিতে বাউন্ডারি মারায় পিছিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা৷ এবারের বিশ্বকাপে চার ম্যাচে বাংলাদেশের বাউন্ডারি কেবল ৩০টি, ছক্কা ২টি৷ ফলে বিশ্বকাপ থেকে একটা মাত্র জয় নিয়ে বিদায় নিয়েছে নিগার সুলতানার দল৷
২০ ওভারের খেলায় ৩১৪ রান, পাহাড় মনে হতেই পারে৷ পুরুষদের ক্রিকেটে ২০২৩ এশিয়ান গেমসে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে নেপালের এই স্কোরই টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ৷ ১২ অক্টোবর বাংলাদেশের বিপক্ষে হায়দরাবাদে তাণ্ডব চালিয়ে ভারত ৩০০’র দুয়ারে গিয়েও থামে ২৯৭-এ, যা এই ফরম্যাটে দ্বিতীয় সেরা৷

মেয়েদের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির সর্বোচ্চ ইনিংস কিন্তু আরো বড়! গত বছর অক্টোবরে চিলির বিপক্ষে বুয়েন্স আইরেসে আর্জেন্টিনা করেছিল ১ উইকেটে ৪২৭ রান৷

একইভাবে শচীন টেন্ডুলকারের (২০১০ সাল) ১৩ বছর আগে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক নারী ব্যাটার বেলিন্ডা ক্লার্ক৷ ১৯৭৫ সালে ছেলেদের ওয়ানডে বিশ্বকাপের দুই বছর আগে শুরু মেয়েদের বিশ্বকাপের৷

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মতো বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররাও অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছেন ছেলেদের চেয়ে৷ ছেলেদের দল এখনো এশিয়া কাপ জিতেনি৷ ফাইনালে খেলাই সেরা অর্জন৷ সেখানে সালমা খাতুনের নেতৃত্বে মেয়েরা এশিয়া কাপ জিতেছে ২০১৮ সালে৷

ছেলেদের টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কোর ২১৫ রান (২০১৮ সাল, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা)৷ সেখানে মেয়েদের সর্বোচ্চ স্কোর ২০১৯ সালে মালদ্বীপের বিপক্ষে ২৫৫ রান৷ একই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন নিগার সুলতানা ও ফারজানা হক৷

উন্নতির পথে থাকা বাংলাদেশের মেয়েরা অবশ্য বিশ্বমঞ্চে আলো ছড়াতে পারছে না বহুদিন৷ এমনকি ঘরের মাঠেও পেরে উঠছে না শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে৷ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩-০ আর ভারতের বিপক্ষে নিগার সুলতানা জ্যোতির দল টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরেছিল ৫-০’তে৷ সর্বশেষ খেলা ১০ ওয়ানডেতেও জয় মাত্র ২টি৷

এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরু করেছিল নিগার সুলতানার দল৷ সেটা ছিল ১০ বছর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়৷ এরপর যথারীতি হার ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে৷ শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে মাত্র ১১৮-তে আটকেও ২১ রানে হারতে হয়েছে ব্যাটারদের ব্যর্থতায়৷

বিশ্বকাপ ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল সাউথ আফ্রিকা৷ সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে ৭ উইকেটে হেরেছিল বাংলাদেশ৷ নিগারের দল শুরুতে ব্যাট করে ৩ উইকেট হারিয়ে থামে কেবল ১০৬ রানে৷ ১৬ বল হাতে রেখে লক্ষ্যটা অনায়াসে পেরিয়ে যায় সাউথ আফ্রিকা৷ বাংলাদেশি ৫ ব্যাটারের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৮.৩৭ স্ট্রাইক রেট ছিল সোবহানা মোসতারির৷ সেখানে প্রোটিয়াদের চার ব্যাটার রান করেছেন ১০০’র বেশি স্ট্রাইক রেটে৷ ব্যবধানটা হয়ে যায় এখানেই৷

টি-টোয়েন্টি মানেই চার-ছয়ের খেলা৷ মেয়েদের টি-টোয়েন্টিতে ছক্কা সেভাবে না হলেও রানের গতি বাড়াতে বাউন্ডারি বড় অস্ত্র৷ সেখানেই পিছিয়ে বাংলাদেশ৷ এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চার ম্যাচে বাংলাদেশের বাউন্ডারি ৩০টা, ছক্কা ২টা৷

বাংলাদেশের গ্রুপে থাকা সাউথ আফ্রিকার মেয়েরা গ্রুপ পর্বের চার ম্যাচে বাউন্ডারি মেরেছে ৫১টি, ছক্কা ৩টি৷ ইংল্যান্ড প্রথম তিন ম্যাচেই বাউন্ডারি মেরেছে ৩৯টা, ছক্কা ১টা৷

মেয়েদের বিশ্বকাপে ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ পর্বে বাউন্ডারি মেরেছে ৪৯টা, ছক্কা ২টা৷ ভারতের মেয়েরা বাউন্ডারি মেরেছে ৪৫টি, ছক্কা ৩টি৷

বাউন্ডারি কম হওয়াতেই চার ম্যাচের কোনটিতে ১২০ রান করতে পারেনি বাংলাদেশ৷ এত কম রান নিয়ে এই যুগে এসে বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে ভালো করা কঠিন৷

সমস্যাটা পুরোনো

২০২৩ সালের শুরু থেকে এ বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি ৪০৪টি বাউন্ডারি মেরেছিল অস্ট্রেলিয়া৷ ভারতের বাউন্ডারি ছিল ৩২৭টা আর সবচেয়ে কম ২০৪টি বাংলাদেশের৷

বাংলাদেশ ব্যাটারদের গড় স্ট্রাইক রেটও কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৮২.০৭-তে৷ শুরুতে ব্যাট করে জেতা দলগুলোর গড় স্কোর যেখানে ১৪৫ সেখানে বাংলাদেশের ১২০-এর মত৷

সমস্যা মাঠের বাইরেও

বছর জুড়ে ঘরোয়া মাত্র দুটি টুর্নামেন্ট খেলেন বাংলাদেশের মেয়েরা৷ একটা জাতীয় লিগ আরেকটা প্রিমিয়ার লিগ৷ টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে হওয়া জাতীয় লিগে ম্যাচ সেরার পুরস্কার মাত্র ৫ হাজার টাকা! এই পুরস্কার ২০১৭-১৮ মৌসুমের দিকে ছিল ১ হাজার টাকা৷
বৈষম্য আছে বেতনেও৷ চার ক্যাটাগরিতে ২৫ জন চুক্তিবদ্ধ নারী ক্রিকেটার আছেন বিসিবির৷ গত বছর জুন পর্যন্ত ‘এ’ ক্যাটাগরির চার জন বেতন পেতেন সবচেয়ে বেশি ৮০ হাজার টাকা৷ আর সবচেয়ে কম ২৫ হাজার টাকা৷ অথচ ছেলেদের সবচেয়ে বেশি বেতন পাওয়া ক্রিকেটাররা পান প্রায় ৯ লাখ টাকা৷ এমন বৈষম্য নিয়ে অসন্তুষ্টি থাকলেও প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না কেউ৷

সমাধানে বিসিবির উদ্যোগ

মেয়েদের বেতন বাড়ানো জরুরি বুঝতে পেরে গত বছর জুনে উদ্যোগ নেয় বিসিবি৷ তাতে ২০ শতাংশ বেতন বেড়েছে চার ক্যাটাগরিতেই৷ এখন সর্বোচ্চ ক্যাটাগরিতে থাকা চার জনের বেতন ১ লাখ টাকা করে৷ সর্বনিম্ন বেতন পাওয়া খেলোয়াড় পান ৫০ হাজার টাক৷

ফারুক আহমেদ নতুন বোর্ড সভাপতি হওয়ার পর, জাতীয় লিগে ম্যাচ সেরার পুরস্কার ও প্রাইজমানি বাড়ানোর কথা জানিয়ে রেখেছেন৷ বিপিএলের আদলে মেয়েদের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজনের ভাবনাও আছে বিসিবির৷

বাংলাদেশের মেয়েদের বাউন্ডারি ও ছক্কা মারতে না পারার কারণ হিসেবে বলা হয় শারীরিক গঠন, খাদ্যাভ্যাস, ধীর গতির উইকেটে খেলা-এসব৷ এর সমাধানে ২০২৩ সালে জাতীয় দলের প্রধান ফিজিক্যাল পারফরম্যান্স কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ইয়ান ডুরান্টকে৷ তিনি কাজ করছেন খেলোয়াড়দের শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে, যা কাজে দিবে ব্যাটিং,বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে৷

ইংল্যান্ড নারী জাতীয় দলে প্রায় ১০ বছর স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং নিয়ে কাজ করা ডুরান্ট বিসিবির ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, ‘‘আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে কাজ করছি আমরা৷ জিমে অনুশীলন চলছে৷ ব্যাটাররা কীভাবে ব্যাকফুট থেকে ফ্রন্টফুটে ওয়েট ট্রান্সফার করছে, এরপর কীভাবে ব্যাটের মাঝে বল লাগাচ্ছে, যাতে হাত থেকে শক্তি আসে-এসবে জোড় দেওয়া হচ্ছে৷’’
ডুরান্টের অনুশীলনে সন্তুষ্টি জানিয়ে ওপেনার মুর্শিদা খাতুন সেই ভিডিওতেই বলেছিলেন, ‘‘আগে আমি স্কোয়াট (একপ্রকার ব্যায়াম) করতাম ৪০ কেজি দিয়ে, এখন ৬০ কেজি দিয়ে করি৷ আমরা বাঙালি, ভাত খেতে পছন্দ করি৷ ডুরান্ট বলেছে শর্করা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে রেখে আমিষ বেশি খেতে৷’’

এবারের বিশ্বকাপে অবশ্য ২ ম্যাচে ১২ রানই করেছেন মুর্শিদা খাতুন৷ বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ১৩৪ রান করেছেন সোবহানা মোসতারি আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অধিনায়ক নিগার সুলতানা৷ দুজনই মেরেছেন সমান ৯টি করে বাউন্ডারি৷ তবে সোবহানা মোসতারির স্ট্রাইক রেট ৮৮.৭৪ আর নিগার সুলতানার ৮৬.৬৬৷ এমন ধীর গতির স্ট্রাইক রেট নিয়ে বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে যা হওয়ার তাই হয়েছে বাংলাদেশের৷

অভিজ্ঞদের পরামর্শ

ছেলেদের আগে বাংলাদেশের মেয়েদের দল প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ভেন্যু ইডেনে গার্ডেনে৷ ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চ পশ্চিম বাংলা সভাপতি একাদশের বিপক্ষে বাংলাদেশের মেয়েরা খেলেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রের ব্যানারে৷ সেই দলের উইকেটরক্ষক পারভিন নাছিমা নাহার পুতুল ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় দলেরও খেলোয়াড়৷ ২০০৪ সাল থেকে বিসিবির নারী দলের সহকারী কোচ হিসেবে সালমা খাতুন, জাহানারা আলমদের গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি৷
২০১০ গুয়াংজু এশিয়ান গেমসে রুপা জয়ী মেয়েদের দলের সহকারী কোচের দায়িত্বে থাকা পারভিন নাছিমা নাহার পুতুলের মনে হচ্ছে অভিজ্ঞতার অভাবে ভুগতে হয়েছে বাংলাদেশকে ‘‘এবার ব্যাটিং আর ফিল্ডিংয়ে অতিরিক্ত খারাপ করায় আরেকটা ম্যাচ হাতছাড়া করলাম আমরা (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের আশা জাগিয়েও হার)৷ অনেক নতুন মেয়ে বিশ্বকাপ খেলল৷ এ ধরনের টুর্নামেন্টে কিন্তু অভিজ্ঞ খেলোয়াড় লাগবে৷ এত নতুন মেয়ে নিয়ে বিশ্বকাপ খেলা ঠিক না৷ খাদিজাতুল কুবরা, সালমা, রোমানা- এদের এমন কোন বয়স হয় নাই যে তারা এত তাড়াতাড়ি দল থেকে ছিটকে যাবে৷ নতুন অবশ্যই থাকবে তবে গড গিফটেড যে খেলোয়াড়রা ছিল তাদের ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে৷’’

২০১৮ এশিয়া কাপে সালমা খাতুনের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটের কিংবদন্তিই বলা হয় সাবেক এই অধিনায়ককে৷ এবারের বিশ্বকাপে সুযোগ না পেলেও টিভিতে দেখেছেন প্রতিটা ম্যাচ৷

নিগার সুলতানার দলের উন্নতির জন্য তার পরামর্শ, ‘‘আমাদের মেয়েদের পাওয়ার হিটিংটা খুব প্রয়োজন৷ আমার কাছে এটা মনে হয়, কারণ টি-টোয়েন্টি খেলা মানেই পাওয়ার হিটিং৷ ৭২ মিটার বাউন্ডারিটা আমাদের জন্য একটু কঠিন (বিশ্বকাপে ছিল)৷ আমরা যদি এটার উপরে কাজ করি বা পাওয়ার হিটিংয়ে কাজ করি তাহলে আমাদের মেয়েদের ১২০ বা ১৪০ রান করার সামর্থ্য আছে৷ আমরা যে ১৪০ এর আগে করিনি এমন না৷ তবে এটার উপর আরও কাজ করতে হবে৷’’
শেষ কথাটা আসলে পাওয়ার হিটিং আর বাউন্ডারি৷ বাংলাদেশ ভালো বোলিং করেও বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে বাউন্ডারি মারতে না পারার ব্যর্থতাতেই৷

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ