নারী পরস্পর বন্ধু নয় কেন!
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা সর্বদাই কোণঠাসা তবে নারীকে অবরুদ্ধ করতে আরও বেশি সক্রিয় নারী নিজেই! যে নারী একসময় নিজেই অন্য পরিবারে নতুন বউ হয়ে যায় সেই নারীই আবার তার পুত্রবধূর ওপর চড়াও হন। তিনি যা পাননি বা তার শাশুড়ীমা যা তাকে মানতে বাধ্য করেছেন তিনিও ঠিক তার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি করে শাশুড়ীত্ব ফলান! এ এক আজব মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। নারী হয়েও অপর নারীর প্রতি ভালোবাসা নয় বরং প্রতিযোগিতা, মনোমালিন্য, নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের তাগিদ সবই কাজ করে! শুধু পরিবারে নয় চলার পথে পুরুষ নারীকে যতটা না খামচি দিয়ে টেনে ধরে নারী তার চেয়ে বেশিই। পুরুষ যখন নারীকে কটুক্তি করে তখন তাদের কষ্ট হয়, অপমানিত বোধ হয় কিন্তু এই নারীই যখন অপর নারীর সম্ভ্রম, চলাফেরা, পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন বেশ আশ্চর্য হতে হয়! সহসাই মনে প্রশ্ন আসে- নারী পরস্পর বন্ধু নয় কেন?
কথায় আছে, ‘জীবন ফুলশয্যা নয়’। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে জীবন যতটা সহজ, নারীর ক্ষেত্রে ততটা নয়। নারীর জীবন প্রতিমুহূর্তে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীর জীবনকে চালিয়ে নিতে হচ্ছে কিন্তু সে পথেও অনেক বাধা। নারীর জীবন যে শুধু পুরুষ সমাজই জটিল করছে, এমনটা নয়; বরং নারীরাও তার কেন্দ্রে আছে।
বিষয়টা বোঝার জন্য খুব বেশিদূর আমাদের যেতে হবে না। কিছুদিন আগেই নরসিংদী রেলস্টেশনে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। সেই ঘটনাকে যদি প্রধান সাক্ষ্য মানি তবে নারীর জীবনকে অন্যজন নারীই প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। অপমান-অপদস্থ করেছে। যেই ব্যক্তি এমন ঘটনা ঘটালেন তিনি কি মানবিক-বিবেকসম্পন্ন-রুচিবোধের পরিচয় দিয়েছেন! নারী কেন নারীর শত্রু হবে!
কেন একজন নারী অন্যনারীকে হেনস্তা করবে জনসম্মুখে! বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত। তবে নারীর এই কাজের পেছনে মদদ দেয় একশ্রেণীর উশৃঙ্খল মনোবৃত্তির মানুষ। সেখানে পুরুষ-নারী উভয়ই আছে।
একজন ব্যক্তি কী পরিধান করবে এটা তার নিজস্ব রুচি-অভিরুচির ব্যাপার। সেখানে অন্য কোনো ব্যক্তিরই হস্তক্ষেপ করার প্রশ্নই আসে না। তবে, অনেক নারী-পুরুষ খুব শক্ত এবং বাজেভাবে বিষয়টার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এখানে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তাদের এ পথে চালিত করছে। অনেকেই নারীর এ ধরনের পোশাক পরাকে অশালীন, অশ্লীল বলে বাজে ভাষা ব্যবহার করছেন। কিন্তু নারীর পোশাককে যেই নারী জনসম্মুখে টেনেটুনে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করেছে! তিনি কী ধরনের বোধের পরিচয় দিয়েছেন! তিনি কি অন্য নারীকে অসম্মান করেনি! এমনকি পরে নিজেও অসম্মানিত হয়েছেন। তবে নারী হয়ে কেন নারীর প্রতি এধরনের অত্যাচার করার মনোবাঞ্ছা হলো!
প্রত্যেকের রুচি ও জীবনাচরণ আলাদা। সেখানে ভিন্ন মত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বাবার পাঁচ পুত্র যেমন এক নয়, সেটা চরিত্র বা চেহারায় ঠিক, তেমনি একজনের জীবনযাপন অন্যের মত-পথের সঙ্গে মিল না-ও থাকতে পারে। তাতে কি হাঙ্গামা করা উচিত! বরং যদি না পছন্দ হয়, তবে নীরবে সেখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।
পুরুষ সর্বদাই নারীকে পেছনের সারিতে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যেন নারীরা তাদের টপকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে না পারে। যত রকম বাধার দেয়াল নারীর জন্য সৃষ্টি করা যায়, তার সবকটা করে পরিবার-সমাজ। আর সমাজের মূল হোতা পুরুষ। তাই পুরুষের রুচি অনুযায়ী নারীকে পথ চলতে হবে, এমনটা ধারণা তাদের। কিন্তু মানুষ তার আপন সত্তাকে বিশ্বাস করে। সেভাবে নিজেকে সাজাতে চেষ্টা করে। তবে নারীর জীবন কেন নারীর নয়?
অন্য একজন পুরুষ বা নারী কেন নারীর চলার পথের বাধা হবে? এক্ষেত্রে একজন নারী অন্য নারীর কখনোই মঙ্গলকামনা করতে পারে না, এমনটাই সমাজের সবারই ধারণা। তবে এ ধারণা যে মিথ্যা নয়, সেটা পরিবার-সমাজে -কর্মস্থলে প্রতিটি জায়গায় পরিলক্ষিত হয়। একজন ছেলে ও একজন মেয়ের মধ্যে যতটা স্বচ্ছ বন্ধুত্ব হয়, একজন নারীর সঙ্গে অন্য নারীর ততটা হয় না। কারণ নারীর মধ্যে উদারতার অভাব রয়েছে।
আবার দুজন মেয়ে যদি রুম শেয়ার করে থাকে, সেখানেই দ্বন্দ্ব অনিবার্য। একজন অন্যজনকে সহ্য করতে পারে না বিভিন্ন কারণে। পুরুষের ক্ষেত্রে এমনটা খুব কম দেখা যায়। কারণ তারা এদিকে একটু উদাসীন-উদার। নিজেদের পাওনাটা প্রাধান্য দেয়, বাকিটা ভাবে না। নারীরা পুরোটা নিজের মতো করে পেতে চাওয়ার কারণে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
এ তো গেলো খুব ক্ষুদ্র পরিসরের কিছু কথা। নারীই যে নারীকে এগিয়ে দেবে, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব রাখবে, তা না করে সমস্যার সৃষ্টি করে।
শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর প্রধান সমস্যা বাধে বউ-শাশুড়ির মধ্যে। অবশ্য বাংলা সিনেমাও আছে এ নিয়ে। নারীই কিন্তু সেখানে নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। একজন শাশুড়ি ও একজন বউমা যদি দুজনে একে অন্যের সহযোগী হতো, তবে নিশ্চয় এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শোনা যেতো না।
কর্মক্ষেত্রেও নারীরাই নারীদের নিয়ে কটু মন্তব্য করে। কেউ একজন ভালো পারফরম্যান্সের ফলে পদোন্নতি পেলে বা সুনাম কুড়ালে, সেখানে ইস্যু তৈরি করা নারীদের মানসিক প্রবৃত্তি হয়ে গেছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতি আর কতকাল চলবে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন প্রয়োজন।
পথেঘাটে, গণপরিবহনে নারীদের নিজেদের সম্মানটা নিজেদের বাড়াতে হবে। একজন নারী অন্য নারীর রুচি-ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিচার বাইরে থেকে করা যায় না বরং বিচার করতে হলে সমস্যার গভীরে ঢুকতে হয়।’ তেমনি অন্যকে সম্মান করলে তবেই সমান আশা করা যায়। নিজের অবস্থান উন্নত করতে হলে আগে নিজেই ওই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। নারীদের এই ছোট্ট কিছু কথা মাথায় ঢুকিয়ে না নিলে তারা মুক্তি পাবে না।
পুরুষ তো শোষণ করেই, সেখানে নারীরাও যদি সঙ্গে হাত মেলায়, তবে তালি তো বাজবেই! নারীদের জীবনও ততটাই সংকটে পড়বে। তাই এখনই সময় নারীই নারীর শত্রু না হয়ে বরং সহযোগী-বন্ধু হয়ে উঠুক। তবেই নারী-জীবনের সব সংকট-দুর্দশার অবসান ঘটবে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা কখনও কাউকে ছোট করে না। বরং মহীয়ান করে তোলে। কিন্তু আমাদের সমাজ বদলেছে, চেতনা বদলেছে। মানুষ কেমন জানি পশুর মতো হয়ে উঠেছে। আচরণে, চলাফেরায় সহমর্মিতা নেই। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা নেই। মানুষ জানে না বা বুঝতে চেষ্টা করে না যে, ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে কল্যাণ সাধন হয় না। তাই কেউ কাউকে ছোট করে নয় বরং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা- সহমর্মিতা রেখেই পৃথিবী জয়ের গল্প লিখতে হবে।