ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমেই নারীর সর্বনাশ!
আজ অবধি আমাদের সমাজে নারীরা অবহেলিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত। কোথাও নারীর যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করা হয় না। নারীকে মূল্যায়ন করা হয় তার বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে। এই সৌন্দর্য নির্ধারণ করেছে পুরুষতন্ত্র। ফলে সমাজে প্রচলিত সুন্দর-অসুন্দর, সুশ্রী-কুশ্রী শব্দসমূহ শুধু নারীর সঙ্গেই সম্পৃক্ত। কখনো পুরুষের ক্ষেত্রে কুশ্রী-কুদর্শন শব্দটি ব্যবহার করতে দেখা যায় না। এমনকি পুরুষের সঙ্গে নারী আজীবন পার করে দিলেও কখনো পুরুষের সৌন্দর্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না! তবে নারীর সৌন্দর্য নিয়ে এত কেনো চর্চা, এত কেনো মন্তব্য, কাঁদা ছোড়াছুড়ি? যেখানে বলা হয় সোনার আংটি বাঁকাও ভালো! অর্থাৎ পুরুষ মাত্রই স্বর্ণের সঙ্গে তুলনীয়। সেখানে নারীকে নামকরণ করা হয় কালো, শ্যামলা, মোটা, শুকনা, বেঁটে, লম্বা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে!
নারীর সৌন্দর্য নিয়ে এত কটাক্ষের কারণেই অধিকাংশ নারী হীনণ্মন্যতায় ভোগেন! যিনি আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনিও মনের কোণে কোথাও একটা অতৃপ্তি বোধ করেন! ফল দাঁড়ায় নিজের সৌন্দর্যচর্চায় ব্যবহার করেন নানাবিধ পণ্য। এসব পণ্যের গুণগত মান যাচাই-বাছাই না করেই ব্যবহার করতে উদ্যোত হন। যার পরিপ্রেক্ষিতে নারীর জীবনে ডেকে আনে চরম সর্বনাশ। নারীর এ ধরনের সৌন্দর্য চর্চায় হতে পারে ক্যানসার এবং অন্যান্য বিবিধ ত্বক সংক্রান্ত সমস্যা। তবু হরহামেশাই নারীরা পুরুষতন্ত্রের ফাঁদে পড়ে সৌন্দর্য চর্চায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অনলাইন-অফলাইনে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের রমরমা ব্যবসার পসারও বসিয়েছেন অনেকে। এসব পণ্য সংগ্রহ করে অনেক নারীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন! রঙ ফর্সা করতে গিয়ে বেশিরভাগক্ষেত্রে হিতে বিপরীত পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন নারীরা!
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত নারীর সৌন্দর্যের মাপকাঠি তার গায়ের রঙ। ফলে যেই নারীর গায়ের রঙ ফর্সা তাকে স্বাভাবতই সুন্দর-সুশ্রী রূপে গণ্য করা হয়। এরপরও নারীর সঙ্গে আরও মন্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়। কোনো নারী মোটা কিনা, বেঁটে কিনা সেসব নিয়েও নানামুখী আলাপ-আলোচনা-সমালোচনা এ সমাজে রয়েছেই। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে নারী কেনো তার স্থান তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেন না! গায়ের রঙ, মোটা, বেঁটে, কালো- শ্যামবর্ণ এগুলো মানুষের হাতে নয়। সৃষ্টি এবং জন্মরহস্যেই তা লুকিয়ে রয়েছে। তবু এ সমাজ একটি মানদণ্ড তৈরি করেছে। নারীকে মেপে মেপে চলতে যেমন বলা হয় তেমনই নারীর সৌন্দর্য নিয়েও ঘটা করে কটাক্ষ করা হয়। নারীকে বিদ্রুপ করা হয়!
এর ফলে নারীরা হীনমন্যতায় ভোগেন। মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এজন্য নারী এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপয় খুঁজতে চেষ্টা করেন। এবং একপর্যায়ে দেখা যায় দেশের হাজার ভেজাল পণ্যের মতো ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমও ভেজালে ভরা। আর বুঝে না বুঝে নারীরা এসব ব্যবহার করে জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছেন! এবং নারীরা নিজেদের সুন্দর করতে গিয়ে হয়ে পড়ছেন আরও রোগাক্রান্ত!
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদে এমনটাই ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন নারী এই ভয়াবহতার শিকার। নিজেদের মুখের ত্বককে ফর্সা করতে গিয়ে পড়েছেন বিপাকে। রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারে মুখ ঝলসে গেছে এসব নারীর। ভয়বহতার শিকার এসব নারীরা জানান, বাজারে প্রচলিত রঙ ফর্সাকারী ক্রিম থেকেই তাদের এই অবনতি!
এখন প্রশ্ন হলো এই নারীরা যেমন নিজেরা দোষী তেমনই এই দোষ তার একার নয়। সংবাদ প্রকাশিত হলে অনেকেই তাদের কটাক্ষ করছেন। কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়,কেনো এই নারীরা নিজের চেহারা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এককথায় বলায় যায়, পুরুষতন্ত্রের বিদ্রুপ, কটাক্ষের ফলে। কারণ গায়ের রঙ ফর্সা না হওয়ার কারণে এ সমাজে অনেক নারীকে হিংস্রতার শিকার হতে হয়। এই নারীরাও যে তার শিকার নয় এমনটা ভাবা বোকামি। ফলে তারা না বুঝে-জেনেই ঝোঁকের বশে সহজ সমাধান খুঁজেছে। পুরুষতন্ত্রের প্ররোচনা, কটাক্ষ, বিদ্রুপ তাদের একাজে চালিত করেছে। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ী। যারা বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়ায় অফলাইন-অনলাইনে পসরা বসিয়েছে। মুখোরচক বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট করে নারীদের ক্ষতির সম্মুখীন করে তুলছেন!
নারীদের এ থেকে রক্ষা করতে প্রথমত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি। পুরুষতন্ত্রের এমন জাজমেন্টাল মোনোভাব নারীর জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনছে! তবে নারীকেও সচেতন হতে হবে। বিশ্বাস এবং আস্থা রাখতে হবে নিজের কর্ম, জ্ঞানের ওপর। সমাজের আর দশটা মানুষ খারাপ বললেই খারাপ বা কুশ্রী হয়ে যাবেন এমনটা কেনো! সৌন্দর্য মনে। বাহ্যিক সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে মনকে কলুষিত করা থেকে বিরত থাকুন। যদি আলোকিত করতেই হয়, রঙ ছড়াতেই হয় তবে মনের রঙ, জ্ঞান, প্রজ্ঞায় তা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তার জন্য গায়ের রঙ গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এসব ফর্সাকারী ক্রিম দিয়ে জীবনকে নরকে পরিণত করা থেকে বিরত থাকতে হবে নারীকেই। ভালো-মন্দের বিভেদ বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ সমাজ কখনোই নারীকে সাধুবাদ জানায় না। জানাবে না। কারণ পুরুষতান্ত্রিকতার ফাঁদে আঁটকে আছে পরিবার-সমাজ তথা রাষ্ট্র। ফলে নারীও যদি নিজের মূল্য না বুঝে এই মানসিকতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে সর্বনাশের খেলায় মেতে ওঠে তবে তার ফল ভয়াবহ হবেই।
সর্বোপরি বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি। কঠোর আইন প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নের পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের অনুমোদনহীন এসব পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা সমাজের কথা গায়ে মেখে আরও অনেক নারী নিজেদের মনোবল হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন এসব অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডে। মানুষের কথাকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য তেমনই আবেগও। ফলে আবেগী হয়ে নারীরা এ ধরনের পদক্ষেপ নিলেই এমন বিভৎসতার শিকার হতে পারে! নারীদের সচেতন হতে হবে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা এতটা সহজ নয় তবে নারী যদি নিজের ওপর আস্থা রাখে তবে নিজেই এই ধারণাকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে। তাই সবকিছু বিবেচনা করে এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে এ ধরনের বিভৎসতার শিকার আর কেউ না হন।