জেসিকার খুনি কে?
‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ ২০১১ সালে ভারতে মুক্তি পাওয়া একটি জীবনী চলচ্চিত্র। ক্রাইম থ্রিলারও বলা যায়। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয় এই চলচ্চিত্র। ১৯৯৯ সালে জেসিকা লাল নামক এক মডেল ও রেস্তোরাঁকর্মীকে এক ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীর ছেলের হত্যা ও হত্যার রায়কে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্রের কাহিনী। রাজকুমার গুপ্তার লেখা ও নির্দেশনায় নির্মিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন বিদ্যা বালান, রাণী মুখার্জী, রাজেশ শর্মাসহ আরো অনেকে।
দুই নারীর সংগ্রাম, ধৈর্য্য, তীব্র ইচ্ছাশক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা সত্যকে বের করে আনার অসাধারণ কাহিনী ফুটে উঠেছে এই চলচ্চিত্রে। রাণী মুখার্জীর অসাধারণ অভিনয়ের জন্য মীরা চরিত্রে ওইবছর দুইটি এওয়ার্ড পেয়েছেন। ‘মোস্ট এন্টারটেনিং সোশ্যাল ফিল্ম’ এওয়ার্ডও পায় এই চলচ্চিত্র। বিদ্যা বালানসহ প্রত্যেকেরই অভিনয় অসাধারণ ছিলো পুরো চলচ্চিত্রে।
কাহিনীর শুরুতে দেখা যায় মীরা গাইতি বা রাণী মুখার্জী দিল্লির একজন বিখ্যাত সাংবাদিক।
অন্যদিকে জেসিকা লাল ও সাবরিনা লাল দুই বোন তাদের পরিবার নিয়ে দিল্লিতে বাস করে। জেসিকা বড় বোন ও সাবরিনা ছোট বোন। সাবরিনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিদ্যা বালান। জেসিকা লাল একটু চঞ্চল এবং সাবরিনা লাল শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের। জেসিকা একটু প্রতিবাদী ও চটপটে। রাস্তায় কোনো ছেলে তাকে উত্তক্ত করলে সাবরিনা যেখানে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চায় জেসিকা যেখানে গিয়ে ওই ছেলেকে শাঁসিয়ে আসে। জেসিকা লাল মডেলিং করে ও দিল্লির এক বড় রেস্তোরাঁয় কাজ করে। সব মিলে তাদের জীবন ভালোই চলছিলো কিন্তু একরাতে অনাকাক্সিক্ষত এক ঘটনা পুরো পরিবারকে তছনছ করে দেয়।
রাতে সাবরিনা ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ ফোনে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফোন করেছে জেসিকার এক বন্ধু ও কলিগ দিলীপ। ফোন ধরে সাবরিনা একটি বড় ধরনের ধাক্কা পায়। ফোনে শোনে যে তার বোন জেসিকাকে গুলি করা হয়েছে ও সে হাসপাতালে ভর্তি। শুনেই সাবরিনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সাথে সে ও তার পরিবার হাসপাতালে চলে আসে। সেখানে এসে সাবরিনা জেসিকার গুলি লাগার সম্পূর্ণ কাহিনী জানতে পারে।
জেসিকা রেস্তোরাঁর বারে রাতে কাজ করছিলো। সেখানে এক ছেলে তার দুই বন্ধু নিয়ে তার কাছে আসে মদ চায়। কিন্তু বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও মদ শেষ হয়ে যাওয়ায় জেসিকা ও তার বন্ধু তাদের মদ দিতে অস্বীকার করে। এতে সেই ছেলে বকাবকি করতে থাকে জেসিকাকে ও এক পর্যায়ে পিস্তল বের করে জেসিকাকে গুলি করে। গুলিটি সরাসরি জেসিকার মাথায় গিয়ে লাগে এবং তৎক্ষণাৎ সে পড়ে যায় ও জ্ঞান হারায়। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালে জেসিকা মারা যায়। সাবরিনা সেই ছেলের নামে জেসিকাকে হত্যার দায়ে মামলা করে। সেই ছেলে হলো হারিয়ানার ধনাঢ্য মুখ্যমন্ত্রী ভুপেন্দর সিংয়ের ছেলে মনু শর্মা।
মনু শর্মাকে গ্রেপ্তার করা হলেও টাকা আর ক্ষমতার জোড়ে তার পিতা তাকে বেকসুর খালাস করাতে সক্ষম হয়। রেস্তোরাঁয় ৩০০ চাক্ষুস সাক্ষী থাকা সত্ত্বেও কেউ আদালতে সত্য কথা বলেনা। ভুপেন্দর সিং সকল সাক্ষীকে টাকা দিয়ে কিনে নেয় নয়তো হত্যার হুমকি দিয়ে তাদের বক্তব্য পাল্টে দেয়। এমনকি মনুর নিজের অপরাধ স্বীকারোক্তি থাকা সত্ত্বেও রায় মনুর পক্ষেই যায়। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই মনু জেল থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। এরমধ্যে সাবরিনা তার বোন জেসিকার মামলার প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের দ্বারে দ্বারে ঘোরে আদালতে সত্য কথা বলার জন্য কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করেনা। আশ্বাস দিয়েও পরে মিথ্যা বক্তব্য দেয় আদালতে অনেকে।
কিন্তু এই কেসে পুলিশ সাবরিনাকে অনেক সাহায্য করে এবং শেষ পর্যন্ত সাহায্য করে গেছেন তিনি। এসময় সাবরিনাকে একদিকে তার পরিবার সামলাতে হয় আবার মামলার সকল ব্যবস্থাও করতে হয়। এরমধ্যে মেয়ের মৃত্যু ও হত্যাকারীর বেকসুর খালাস এর ট্রমা জেসিকার মা নিতে পারেনা। হার্ট এ্যাটাকে তিনি মারা যান এবং তার পিতা আইসিইউতে থাকে। পরিবারের এই বেহাল দশায় অবশেষে সাবরিনা বোনের ন্যায়বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে তার অসুস্থ পিতার সেবা করে ও তার মতো স্বাভাবিকভাবে চলার চেষ্টা করে। এই ইস্যুটা প্রায় চাপা পড়ে যায়।
কিন্তু এরমধ্যে জেসিকা হত্যাকান্ডের এই বিষয়টা বিখ্যাত সাংবাদিক মীরার নজরে আসে। বিষয়টি তার মনে লাগে যে একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির ছেলে তুচ্ছ বিষয়ে নিরঅপরাধ একজন মেয়েকে অকারনেই সবার সামনে মেরে ফেলল আর কেবল ক্ষমতার জোড়ে ছেলেটি বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। তাই তিনি এর পুরো সত্য সবার সামনে তুলে আনার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবে একে একে তিনি বিভিন্ন কৌশলে সকল সাক্ষীদের কাছ থেকে সত্য প্রমাণসহ বের করে আনেন। আর কীভাবে সেই মুখ্যমন্ত্রী সকল সাক্ষীকে জোড় করে ও টাকা দিয়ে আদালতে মিথ্যা বক্তব্য দিতে বাধ্য করিয়েছিলেন এসবও প্রমাণসহ বের করে আনেন তিনি।
এরপর সকল প্রমাণ ভিডিও তিনি টিভিতে প্রচার করে ও সবাই মনু শর্মার সত্য জেনে যায়। মিডিয়াতে আসার পর যখন পুরো দেশ সত্য জেনে যায় তখন মনুর বাবার উপরমহল থেকেও রাজনৈতিক চাপ আসতে থাকে এবং মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় তাকে। কিন্তু এতোদিনে বোন, ন্যায়বিচার ও মাকে হারিয়ে সাবরিনা হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু মীরা এসে তাকে ভালো করে বোঝায় এবং সে এরপর সুপ্রিমকোর্টে মামলা করে। এবার তো প্রমাণ আগে থেকেই মীরার কাছে উপস্থিত। কাজেই এবার আদালতে জেসিকা হত্যার সকল প্রমাণ উপস্থাপন করে সাবরিনা। আদালতে মনু শর্মা দোষী প্রমাণিত হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। অবশেষে জেসিকা লাল ন্যায়বিচার পায়।
এই চলচ্চিত্রের নাম ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ অর্থাৎ ‘কেউ জেসিকাকে হত্যা করেনি’ হওয়ার কারণ হলো যখন প্রথমে আদালতে মনু শর্মার বিরুদ্ধ জেসিকা হত্যার মামলার বিচার হয় তখন মনুর পিতা সকল প্রত্যক্ষদর্শীকে আদালতে যেই সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করে তা হলো- “আমি মনুকে পিস্তল চালাতে দেখিনি। জেসিকার ওপর যখন গুলি চলে তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলামনা। গুলির শব্দ শুনে সেখানে আসি। তাই হত্যা মনু শর্মা করেছে কিনা আমি জানিনা।” সকলের বক্তব্য অনুসারে হয় জেসিকাকে কেউ গুলি করতে দেখেনি কিন্তু তাও জেসিকা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। তাহলে কেউ জেসিকাকে হত্যা করেনি। এথেকে এই চলচ্চিত্রের নাম ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’।