আবারও প্রকাশ্যে নারীহত্যা: কোথায় বাস করছি আমরা
এ সমাজে নারী হয়ে বেঁচে থাকা বা টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। ঘরে-বাইরে নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। কোন সমাজে বসবাস করছি আমরা! নারী কি শুধুই ভেগ্যবস্তু? তার নিজস্ব মত-পথ থাকতে পারে না? আর কত আক্রোশ উগ্রে দেওয়া হবে নারীর প্রতি! এ সমাজের অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর কত মেয়েকে এভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে? কত মুক্তি রানি, রাবেয়াকে প্রাণ ত্যাগ করতে হতে হবে পুরুষের আক্রোশে! কী বীভৎস সমাজে আমাদের উপস্থিতি! এর দায় কার!
গত ২ মে নেত্রকোনার বারহাট্টায় দশম শ্রেণির স্কুল ছাত্রী মুক্তি রানি বর্মণকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে একই গ্রামের কাওসারের বিরুদ্ধে। যেকিনা মুক্তি রানিকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। অভিযোগে বলা হয়ে, এরই জের ধরে কাওসার প্রকাশ্য দিবালোকে স্কুল থেকে ফেরার পথে মুক্তি রানিকে হত্যা করে। এবার খুন হলো রাবেয়া আক্তার ( ২১)। সেও খুন হয়েছে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায়। বাসার মধ্যে ঢুকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। এই মৃত্যুগুলো গায়ে শিহরণ জাগায়। ভয়ঙ্কর সমাজে বসবাস করছি আমরা। নারীদের নিরাপত্তা এতটা ঠুনকো হয়ে উঠছে দিন দিন! কোথায় মানবিকতার চর্চা! কোথায় মনুষ্যত্ব? মানুষ হয়ে মানুষকে কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্টভাবে শেষ করে দেওয়া যায়! একটি জীবনের মূল্য এতটা ক্ষীণ! পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কি গুহায় লুকিয়ে জীবনধারণ করবে?
কোন সমাজকে আধুনিক তথা সভ্য সমাজ রূপে জয়গান করছি আমরা? যেই সমাজে আমাদের নারীরা ঘরে-বাইরে কোথাও-ই নিরাপদ নয়। না মুক্তি রানি বেঁচে থাকছে, না থাকছে রাবেয়া আক্তার। রাবেয়া আক্তার বা মুক্তি রানীর কি নিজের পছন্দ-অপছন্দ-মত-পথ থাকতে পারে না? এত আক্রোশ কেন পুরুষের? একসময় নারী বিয়ে বা প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেই তার মুখ-শরীর এসিডে ঝলসে দেওয়া হতো! এখন এসেছে হত্যা, ধর্ষণ, গুম, যৌন-হয়রানি! আর কত নিচে নামবে এ সমাজ! যারা এত ধর্মের আবরণকে টেনে গায়ে জড়াতে ব্যস্ত তারা দয়াকরে এই নারীদের প্রাণ বাঁচানোর মানবিক শিক্ষা দিন।
মানুষের মধ্যে থেকে বিবেক, মনুষ্যত্ব গায়েব হয়ে গেছে। মানুষের মতো এত হিংস্র পশু হয়তো পৃথিবীতে একটিও নেই! কী দোষ রাবেবা আক্তারের? তার মা- তিন বোনকেই বা কেনো কুপিয়ে জখম করা হয়েছে? মা ইনসুরেত নেছা আইসিইউতে! তিন বোন হাবিবা, খাদিজা, জান্নাত ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছে। এই সমাজই কী আমাদের চাওয়া!
মুক্তি রানি, রাবেয়াদের এবার ছাড়ুন। একটু বাঁচতে দিন। পৃথিবীর আলো-বাতাস তাদেরও প্রয়োজন। তারা কেন অকালে প্রাণ হারাবে? কাওসার, সাইদুল ইসলামদের সৃষ্টি করছে কারা? এর নেপথ্যে কি এ সমাজের হীন মানসিকতা, বিকৃত রুচি, আর নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবায় যথেষ্ট নয়? নারীকে যদি চাইলেই পাওয়া যায়, এ ধারণা পোষণ না করতো, তবে কি সত্যিই এই নারীরা অকালে প্রাণ হারাতো! এ সমাজের এত বীভৎসতা, হিংস্রতা নারীকে দমবন্ধ করা একটি পরিস্থিতির শিকার করে তুলছে! এর দায় কার? গত কয়েকদিন যাবৎ ট্রেন্ড চললো বুশরা আফরিনকে নিয়ে ট্রল করা! এই নারীকে যারা ট্রল করছেন, ভালো দৃষ্টিতে দেখছেন না, চোখে শুধু ‘হিট অফিসার’ না দেখে ‘হট অফিসার’ হিসেবে দেখছেন, তারা সত্যিই কি সাইদুল, কাওসারদের চেয়ে ভিন্ন!
পরিবারে সন্তানকে যখন বড় করা হচ্ছে তখন কেন এত আক্রোশ গড়ে তোলা হচ্ছে! একজন মানবশিশু জন্মেই শিখছে না হিংস্রতা? যারা তাকে আগলে রাখার কথা, তারা পৃথিবীর হিংস্রতা শেখাতে ব্যস্ত! যারা মানবিকতা নয় বরং ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নারী-পুরুষকে আলাদা করছে! যারা ছেলে সন্তানকে শেখাচ্ছে, পৃথিবী তোমার বশে! তুমি যা চাইবে তাই হবে! এই নোংরামি আর কত! পরিবার তো নারী-পুরুষ ভিন্ন নয় বরং নারী ও পুরুষের সম্মিলিত সহোযোগিতায়ই গড়ে ওঠে! তবে কেন সন্তানদের ভালোর শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না? একটি পিঁপড়ার প্রাণ নিলেও যেখানে হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হয়, সেখানে মানুষ হত্যার শিক্ষা কিভাবে গড়ে উঠছে! আর কত নিচে নামবে সমাজ!
যতদিন পরিবার-শিক্ষালয় সর্বোপরি সমাজে নারীকে মানুষ না মনে করা হবে, তার মত-পথের মূল্যায়ন করা না হবে, নারী যে ভোগ্যবস্তু নয়, তাকে চায়লেই পাওয়া যায় না এই মানসিকতা গড়ে তোলা না যাবে ততদিন নারীর বাঁচার আর সুযোগ নেই! তাহলে কি নারীদের ঘাপটি মেরে ঘরে স্থান নিতে হবে? তাও তো সাইদুলের মতো নরপশু রাবেয়াকে খুন করবে!
বিচার, আইন, আদালত, সমাজ কোথায়? কেউ কী নারীদের হাহাকার, হৃদয়ের আর্তনাদ শুনতে পায় না! নারী হয়ে জন্মলেই নারীকে মরতে হবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে যৌতুকের দায়ে গলা টিপে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়া হবে, বাল্য বিয়ে দিয়ে আজন্ম পঙ্গু করা হবে, নারীকে পুতুল বানিয়ে ঘরের কোন আবদ্ধ করতে তাকে বস্তা বন্দি করা হবে, স্বামী- শ্বশুর বাড়ির লোকের দাসত্ব করে আজন্ম কাটাতে হবে! নারীর নিজের বলতে কি কিছুই থাকবে না! এমনকি মতপ্রকাশের অধিকারটাও নয়! আর কত? এ সমাজ কি তবে কারাগারে পরিণত হচ্ছে! নারীর জন্য কি কেবলই মৃত্যু অপেক্ষা করছে? এবার একটু থামুন। নারীকে বাঁচতে দিন।