Skip to content

৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২২শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মৃত সাগর!

বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে রহস্যের যেন কোনো শেষ নেই। এ-সব রহস্য আমাদেরকে উৎসাহিত ও উৎফুল্ল করে তোলে। পৃথিবীর এমন অনেক রহস্যই আছে, যার এখনো কোনো হদিস মেলেনি। আবার এমন রহস্যও আছে, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রাকৃতিক ইতিহাস, বিজ্ঞানের ছোঁয়া কিংবা আঞ্চলিক কল্পকথা। পৃথিবীর অন্যতম এক বিস্ময়কর সাগর ‘মৃত সাগর’ সে-রকমই একটি।

‘ডেড সি’ বা ‘মৃত সাগর’ নাম শুনে কি ভাবছেন, এটি একটি সাগর? এটি কোন সাগর নয়, মূলত একটি হ্রদ। পৃথিবীর অন্যান্য সব সাগরের তুলনায় মৃত সাগরের পানি ১০ গুণ বেশি লবণাক্ত হওয়ার কারণে এ পানিতে কোন ধরনের উদ্ভিদ বা মাছ বাঁচতে পারে না। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে ডেড সি বা মৃত সাগর।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডান এবং ইসরায়েলের মধ্যবর্তী স্থানে মৃত সাগরের অবস্থান অর্থাৎ মৃত সাগরের পূর্ব সীমান্তে জর্ডান এবং পশ্চিম সীমান্তে ইসরায়েল। মৃত সাগরের পৃষ্ঠভাগ স্বাভাবিক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪২০ মিটার নিচে। তাই, একে ভূপৃষ্ঠের সব চেয়ে নিম্নভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে এ হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৩০ মিটার (১০৮৩ ফিট) এবং দৈঘ্য প্রায় ৬৭ কিমি ও প্রস্থ সর্বোচ্চ ১৫ কিমি।

প্রায় তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান জর্ডান নদী, মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হতো। ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল। প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে জেজরিল উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ ধীরে ধীরে উঁচু হতে থাকে। এক পর্যায়ে উপসাগরটি চারদিকে ভূমি দ্বারা বেষ্টিত হয়ে এক বিশাল হ্রদ পরিণত হয়।

মৃত সাগরের পানিতে ভেসে থাকার জন্য আপনাকে কিছুই করতে হবে না। যারা সাঁতার জানে না, তারাও এখানে নিশ্চিন্তে ভেসে থাকতে পারবে। এমনকি ইচ্ছা করেও ডুবতে পারবে না। এখন ভাবছেন, তো কিভাবে, অতিরিক্ত লবণের কারণে মৃত সাগরের পানিতে প্লবতা অনেক বেশি। প্লবতা হলো, পানিতে ভাসমান বস্তুর ওপর পানির ঊর্ধ্বমুখী বল। কোন বস্তুকে পানিতে ছেড়ে দেওয়া হলে বস্তুর ওজন নিচের দিকে বল প্রয়োগ করে, সেই সাথে পানি বস্তুকে ওপরের দিকে ঠেলে দেয়। যদি বস্তুর ওজন বেশি হয়, তবে বস্তু ডুবে যায়। আর পানির ঊর্ধ্বমুখী বল বেশি হলে তবুও বস্তু পানিতে ভেসে থাকে। অর্থাৎ, পানিতে ভাসমান কোন বস্তুর ওপর প্রযুক্ত পানির ঊর্ধ্বমুখী বলই হলো প্লাবতা।

মৃত সাগরে নিশ্চিন্তে ভেসে থাকতে পারবেন। এমনকি ইচ্ছা করেও ডুবতে পারবে না।

মৃত সাগরের পানির প্লবতা বেশি হওয়ার কারণ হলো, এর পানিতে অস্বাভাবিক লবণাক্ততা। এই পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ৩৪.২% অর্থাৎ, এই সাগরের ১০০ গ্রাম পানিতে প্রায় ৩৪ গ্রাম লবণ, যা সাধারণ সমুদ্রের পানির চেয়ে ১০ গুণ বেশি। অন্যান্য মহাসাগরের পানি মৃত সাগরের পানিতে মিশে থাকা খনিজ উপাদানের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মৃত সাগরের পানিতে বিদ্যমান লবণে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড ৫০%, সোডিয়াম ক্লোরাইড ৩০%, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড ১৪% এবং পটাশিয়াম ক্লোরাইড ৪%।

চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্য মৃত সাগর অঞ্চলটি গবেষণাস্থল হয়ে উঠেছে। এর মূলে রয়েছে হ্রদের পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি, বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য এবং পরাগরেণুর স্বল্পতা, উচ্চ ভূ-মণ্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতি বেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি। উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, শ্বাসকষ্ট এ-ছাড়া, চর্মরোগীদের জন্য দীর্ঘ সময় সূর্যস্নান বেশ উপকারী।

এ অঞ্চলে অতি বেগুনি রশ্মির স্বল্পতা সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এ-ছাড়া, মৃত সাগরের লবণাক্ত কাদা ঔষধ ও প্রসাধনী তৈরিতে প্রসিদ্ধ। নানা ধরনের চর্ম চিকিৎসায় কাদা ব্যবহার হয়। পর্যটকরা প্রাকৃতিক প্রসাধনী হিসেবে এই কাদা গায়ে মেখে সূর্যস্নান করে। এই হ্রদে কোনো উদ্ভিদ বা মাছ বাঁচে না বলেই মূলত একে মৃত সাগর বলা হয়ে থাকে। কেবল সামান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অণুজীবের সন্ধান পাওয়া যায়, মৃত সাগরতীরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে উট, খরগোশ, খেকশিয়াল এমনকি চিতাবাঘ দেখতে পাওয়া যায়। অতীতে জর্ডান নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে প্যাপিরাস ও পাম গাছ সমৃদ্ধ বনভূমির অবস্থান ছিল।

বিগত কয়েক শতাব্দীতে মৃত সাগরের আয়তন পরিবর্তিত হয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বর্তমানে এ সাগরের গভীরতা সব চেয়ে কম। অতীতে বহুবার মৃত সাগরের গভীরতা কমে গেলেও ফের বৃদ্ধির ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। কারণ, ১৯৬০-এর দশকে ইসরায়েল মৃত সাগরে পতিত জর্ডান নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। তারপর জর্ডান ইয়ারমুখ নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়। ফলে মৃত সাগর আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে বাইরের কোনো প্রাকৃতিক পানির উৎস মৃত সাগরে গিয়ে পড়ে না। গত ৫০ বছরে মৃত সাগর সমুদ্র পৃষ্ঠে থেকে ৪২০ মিটার বেশি নিচে নেমে গেছে।

সমুদ্রের পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে বেড়ে গেছে এই জলের লবণাক্ততার পরিমাণও। মৃত সাগরের কোনো শাখা-প্রশাখার না থাকায় শুধু সূর্যের তাপে এর পানি বাষ্পীভূত হয়ে যাচ্ছে। পানি বাষ্পীভূত হয়ে গেলেও এতে দ্রবীভূত লবণ তলানি পড়ে থাকে, ফলে দিন দিন লবণাক্তে পরিণত হচ্ছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার করে এই সাগরের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।

ইসরায়েল ও জর্ডান মৃত সাগরের সংরক্ষণে একত্রিত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বরং এর পাড়ে দালানকোঠা, শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এখানকার খনিজ সম্পদগুলো ব্যবহার করছে এই দুই দেশ। খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য গড়ে উঠেছে অসংখ্য কারখানা। এই কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে মৃত সাগরের পানি। দুই দেশের জন্যই এটা অনেক লাভজনক ব্যবসা। এ-সব শিল্প-প্রতিষ্ঠানের কারণে হুমকির মুখে পড়ছে মৃত সাগর।

এখানকার খনিজ সম্পদ অস্বভাবিকভাবে আহরণের কারণে তারা ধীরে ধীরে মৃত সাগরকে ধ্বংস করার জন্য জঘন্য ভূমিকা পালন করছে। খনিজ উপাদানে ভরপুর মৃত সাগর নিজেই বর্তমানে মৃতপ্রায়। এটাকে কেন্দ্র করে পর্যটন ব্যবস্থা গলে তোলার ক্ষেত্রে কোনো পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা নেই। যথেচ্ছ গড়ে তোলা হচ্ছে নানা স্থাপনা।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ