Skip to content

২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাঙালির লোক উৎসব

বাংলা ও বাঙালির সার্বজনীন উৎসব চৈত্র-সংক্রান্তি।বাংলা বছরের অন্তিম দিবসও এটি। বসন্তকে বিদায় জানিয়ে গ্রীষ্মের সুচনা হয় চৈত্র সংক্রান্তির মাধ্যমে। এ দিনটি প্রাচীনকাল থেকে বাংলার বুকে এক অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে আসছে। চৈত্র সংক্রান্তি যেন বাংলা নতুন বছর আসার প্রতীক্ষাপ্রহর। চৈত্র মাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় দিনটি হল চৈত্র সংক্রান্তি। চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে বাংলায় প্রচলিত আছে বহু লোকাচার থেকে পূজো আর্চা ও বিভিন্ন সামাজিক বিধি-বিধান। বাংলা বিভক্তের পর আজও যা অমলিন।

চৈত্র-সংক্রান্তি মূলত হিন্দুপ্রধান উৎসব তবে মুসলিম সমাজরও সমাদৃত। লোককথায় প্রচলিত রয়েছে যে, চৈত্র মাস এবং শেষ দিন যেহেতু সংক্রান্তি তাই এই দুটি শব্দ মিলে সৃষ্টি হয়েছে চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলা পঞ্জিকা মতে, চৈত্র সংক্রান্তি একটি পবিত্র এবং উৎসবমুখর দিন। এদিন থেকেই বিগত বছরের পঞ্জিকার অবসান হয় এবং পরদিন পহেলা বৈশাখ থেকে নতুন বছরে নতুন পঞ্জিকার ব্যবহার শুরু হয়।


প্রাচীন লোককাহিনীতে প্রচলিত আছে যে, মহারাজ দক্ষ তাঁর সাতাশটি কন্যার নামকরণ করেছিলেন, সাতাশটি নক্ষত্রের নামে। তন্মধ্যে দক্ষ রাজের দুটি কন্যার নাম ছিল যথাক্রমে- চিত্রা ও বিশাখা। কালক্রমে চিত্রা ও বিশাখা নাম দুটি রুপান্তরিত হয়ে চৈত্র এবং বৈশাখ নামে পরিচিতি লাভ করে। এমন কাহিনি এপার ও ওপার বাংলা দুই দেশেই প্রচলিত রয়েছে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে।


শাকান্ন উৎসব
গ্রাম বাংলার বউ- ঝিরা ঝাড় থেকে প্রথা মেনে চৌদ্দ প্রকারের শাক তুলে আনতেন। একসঙ্গে সেই শাক।রান্না করে খাওয়া হত। আজও দুই বাংলার অনেক স্থানে এ প্রথার প্রচলন রয়েছে। এছাড়া চৈত্র সংক্রান্তির দিনে নিরামিশ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এইদিনে বাস্তু ভিটায় মাছ মাংস আনা নিষেধ।

হালখাতা
প্রাচীনকাল থেকে জমিদারি খাজনার হিসাব-নিকাশ হত চৈত্র সংক্রান্তির দিনে। এরপর বৈশাখের প্রথম দিন বাংলা নববর্ষের দিনে নতুন খাতায় সেই হিসাব তোলা হত এবং প্রজাগণকে মিষ্টিমুখ করানো হত। পরবর্তীকালেও এই হালখাতার চল বিভিন্ন বানিজ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম বাংলায় আজও মানুষ এই হালখাতার আনন্দ নিয়ে মেতে থাকে।

গমের ছাতুর শরবত উৎসব
এদিন যেমন খাজনার নতুন হিসাব হত, তেমনি এর পরের দিন বাংলা নববর্ষের দিন গ্রামে গ্রামে গমের ছাতু, দই ও পাকা বেল দিয়ে তৈরি বিশেষ এক ধরনের শরবত খাওয়ার প্রচলনও বহুকাল থেকে।

তালতলার শিরনি
চৈত্র-সংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রাম বাংলার আরও এক বিশেষ উৎসব তালতলার শিরনি। এই দিনে প্রতিটি বাড়ি বাড়ি থেকে চাল ও তালের গুড় সংগ্রহ করা হত। যেসব বাড়িতে এসব উপকরণ থাকত না তারা নগদ অর্থ-কড়ি দিত। এরপর গ্রামের কোন পবিত্র তাল বা বটগাছের নিচে এসব উপকরণ একত্রে মিশিয়ে তৈরি হত শিরনি। যা তালতলার শিরনি নামে পরিচিত।

নীল উৎসব
একজন শিব আরেকজন পার্বতীর সাজে সাজে এদের সঙ্গে একজন পাগল সাজে এরপর একদল লোক খোল-করতাল, ঢাক-ঢোল, মৃদঙ্গসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিব-পার্বতীর গান গায়। এই সঙ সাজার উৎসবকে নীল উৎসব বলে।

গম্ভীরা পূজা
বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলসমূহে চৈত্র সংক্রান্তির দিন এখনও গম্ভীরা পূজার প্রচলন রয়েছে।


বিজু বা বৈসাবি উৎসব
বাংলাদেশের চাকমা সম্প্রদায়ের লোকজনের একটি অন্যতম প্রধান পরব হলো বিজু বা বৈসাবি উৎসব। বিজু বা বৈসাবি উৎসব পালিত হয় দুই দিন ধরে। এইদিন সকালবেলা বুদ্ধদেবের মূর্তিকে স্নান করানো হয়। ছেলে মেয়েরা তাদের দাদু-দিদিমাকে নদী বা বৃহৎ জলাশয় থেকে জল বয়ে এনে স্নান করিয়ে আশির্বাদ নেয়।

পাচন উৎসব
পাচন হল নানা রকম সবজির মিশালি একধরনের তরকারি। এই দিনে বাড়িতে যে সব বন্ধু-বান্ধব বা অতিথিরা আসে তাদের এই পাজন দিয়ে আপ্যায়ন করে চাকমারা। এটা ওদের রীতি। তাদের ধারণা বছরের শেষ দিনে সব ধরনের সবজি দিয়ে তরকারি খেলে মঙ্গল হয়।

ত্রিপুরায় চৈত্র-সংক্রান্তি
চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন ত্রিপুরায় বসবাসকারী মানুষজন বাজার অথবা পাহাড় থেকে ফুল সংগ্রহ করে। চৈত্রের শেষ দু’দিন ও বাংলা নববর্ষের দিন ত্রিপুরায় পালিত হয় বৈসু উৎসব। এই দিনে এখানে ব্যাপক পিঠার আয়োজন করা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন বাংলা ভাষাভাষী লোকদের কাছে দিনটি অক্ষয়তিথিয়া নামেও পরিচিত। বাঙালি হিন্দু সমাজে অক্ষয়তিথিয়া উপলক্ষে বিভিন্ন পূজা-পার্বণ করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তি আজও অঞ্চলভেদে নানা আনুষ্ঠানিকতা সঙ্গে জাঁকজমক ভাবে পালিত হয়।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ