নারী মানেই কি আত্মত্যাগ?
আমাদের মায়েরা মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই শিখিয়ে আসে যে, তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ভালো বউ হওয়া, ভালো মেয়ে হওয়া। ভালো মেয়ে আর ভালো বউ-এর সংজ্ঞা আশপাশে যেকোনো মানুষ কে বললেই বলে দিতে পারবে। আর তা হল আত্মত্যাগ করা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয়। নারীদের দমিয়ে রাখার বিভিন্ন তরিকা রয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম একটি যদি বলা যায়, তা হলো নারীর পরিচয়হীনতা। নারীকে আলাদা কোনো পরিচয় তৈরি করতে দিতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনো একদম নারাজ।
জন্মের পর প্রত্যেকটি শিশুকে একটি সুনির্দিষ্ট নাম দেয়া হলেও ধীরে ধীরে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে যেনো তার নামটি মুছে যায়। তখন নারী বেঁচে থাকেন কারো মেয়ে, কারো বোন, কারো স্ত্রী কিংবা কারো মা হয়ে। আর নারীর নিজস্ব বাড়ি বলতেও থাকেনা কিছু। একটা সময় পর্যন্ত বাবার বাড়ি তারপর শ্বশুর বাড়ি। আর বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের বাড়িতে কাটে জীবন। আর এভাবেই নারীর নিজস্ব কোনো পরিচয় বা অস্তিত্ব যে থাকতে পারে তা আমাদের সমাজ ভুলে যায়। নারীর যেনো সমাজে বেড়ে উঠতে কোনো না কোনো অবলম্বন দরকার। নারীকে পরনির্ভরশীল করে তুলতে এই সমাজ শুরু থেকেই যেনো উঠে পরে লেগে থাকে। সমাজের যাঁতাকলে পরে নারীও অভ্যস্ত হয়ে যায় বিষয়টির সাথে।
শুরুটা হয় আমাদের পরিবার থেকেই। ছোটবেলা থেকেই বলা হয়, ‘মাছের মাথাটা ছেলেই খাবে, মেয়েদের খেতে হয় সবার শেষে খাবার অবশিষ্ট থাকলে, স্বামীর খাওয়ার আগে স্ত্রী খেয়ে নিলে সংসারে যেনো ভারী অকল্যাণ চলে আসবে।’ এমন কত শত নিয়মের যাঁতাকলে পরে আছে আমাদের সমাজের নারীরা। আমাদের সমাজের চিরাচরিত চিত্র হলো, আগে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা খাবে তারপর অবশিষ্ট থাকলে নারীরা খাবেন। আজকাল আধুনিক যুগে সিলিং ফ্যান কিংবা এসি চলার কারণে হাতপাখার প্রচলন উঠে গিয়েছে। তবে একটা সময় ছিলো যখন পুরুষ সদস্যের খাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতপাখা নাড়তে হতো নারী সদস্যদের। সেই দিন গুলো পুরনো হলেও খাবার নিয়ে নারীর প্রতি বৈষম্যের দিকগুলো এখনো খুব একটা পুরনো হয়নি৷ কষ্ট করে ঘাম ঝরিয়ে রান্না করার পর নারীকে অপেক্ষা করতে হয় সবার খাওয়ার পর কোন খাবার গুলো বাঁচল তা দেখার জন্য।
লোকে বলে, ঘরে বউ নাকি আনা হয় একটা অগোছালো ছেলেকে গুছিয়ে রাখার জন্য। বউ সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে তাঁর স্বামীকে অফিসে পাঠাবে তারপর সারা দিন স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু কাউকে কখনো এটা কেন শেখানো হয় না যে, রান্না একটা বেসিক লাইফ স্কিল। নিজের কাজ নিজে করা একটা বেসিক লাইফস্কিল। এটা ছাড়া যেকোনো মানুষ যে পরগাছা হয়ে জীবনযাপন যে করে, সেটা নিয়ে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই!
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ছেলের বউয়ের কাছে একগাদা আবদার থাকে। বিয়ের আগে থেকেই যেন লিস্ট করে বসে থাকে বর ও তার পরিবারের লোকজন। তাইতো মেয়ে দেখার সময় তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেন তাদের সব চাহিদা এই মেয়ে পূরণ করতে পারবে কিনা। তারপর বিয়ের পর শুরু হয় বউয়ের উপর সব চাহিদা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বিয়ের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীর জীবন কাটে শশুর বাড়ির লোকেদের চাহিদা পূরণ করতে করতে। এক্ষেত্রে বহু নারী নিজেদের পরিচয়, সুখ, স্বাস্থ্য সব জলাঞ্জলি দিয়ে বসেন।
নারীদের কখনো মেটাতে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের নতুন নতুন খাবারের আবদার, কখনো বাচ্চার গল্প শোনার আবদার, কখনো বাচ্চাদের এলোমেলো করা ঘর গোছানো, আবার বাচ্চাকে পড়তে বসানোর ঝামেলাও নেহাত কম নয়। মা হয়ে যেমন সামলাতে হয় ছেলেমেয়ের আবদার, আবার মেয়ে হয়ে বাবা-মায়ের আবদার আবার কখনো স্ত্রী হিসেবে স্বামীর, বৌমা হিসেবে শ্বশুর-শাশুড়ির আবদার। এত কিছুর ভিড়ে ঠিক নিজের যত্ন আর নেওয়া হয় না।
আবার অন্যদিকে যারা কর্মজীবী নারী আছেন তাদের দিন কাটে আরও বেশি ব্যস্ততায়। সারাদিন কর্মস্থলে সময় কাটানোয় পরিবারের সদস্যদের সেভাবে সময় দিতে পারেন না অনেকে। তাই অবসর সময়ে সবার প্রতি দায়িত্বটাও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।স্বাভাবিক সময়ে কর্মজীবী নারীদের চলতে হয় ঘরে – বাইরে সমান তালে তাল মিলিয়ে। প্রতিদিন ঘুম ভাঙে নতুন এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে। ছুটির দিনগুলোতে সাধারণত পুরুষরা আরাম আয়েশ করে কাটালেও কর্মজীবী নারীদের একইভাবে দিন কাটে।
কিন্তু এতসব দায়িত্ব সামলানোর পরও কথায় কথায় আঙুল তোলা হয় নারীর দিকে। সকালে নাস্তা ঠিকসময়ে তৈরি না হলে ঘরের বউয়ের দোষ, রান্নায় লবণ বেশি বা কম হলে বউয়ের দোষ, বাচ্চা পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করলে বউয়ের দোষ, এমনকি স্বামীর কোনো খারাপ কাজের দায়ও গিয়ে পরে বউয়ের ঘাড়ে। তার উপর চাপিয়ে দেয়া একগুচ্ছ চাহিদার কোন একটা পূরণে খামতি থাকলে তুলোধুনো করতে ছাড়েননা পরিবারের কেউ। এমনকি সেই নারীর বাবা-মা, পরিবারের লোকজনও তাকে শেখায় মানিয়ে নিতে। কারণ, সমাজ মনে করে বিয়ের পর এই চাহিদাগুলো পূরণ করাই নারীর জীবনের লক্ষ্য।
তবে যে আজ গৃহবধূ হিসেবে কথায় কথায় হেনস্তার শিকার হোন, একদিন সে নিজেও শাশুড়ি হিসেবে গৃহবধূর পায়ে পায়ে দোষ ধরবেন। কারণ, যুগের পর যুগ সমাজে যেভাবে এসব নিয়মনীতি শেকড় গেড়ে বসেছে তা অস্বীকার করার মত মানসিকতা খুব কম মানুষেরই তৈরি হয়েছে। প্রগতিশীল চিন্তার কিছু মানুষ পরিবর্তন নিয়ে ভাবছে সত্যি, তবে তার অগ্রগতি খুব একটা চোখে পরার মত না। এ সমস্যা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। নারীর ঘরের কাজগুলোকে সমাজ ঠিক কাজ মনে করতে রাজি নয়।
সমাজে নারীকে যোগ্য মর্যাদা দিতে হলে তার উপর থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত চাহিদাগুলো কমাতে হবে। সবার আগে সমাজ ও পরিবারের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সমাজে নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে। সর্বোপরি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করলেই হয়তোবা আশার আলো দেখা যেতে পারে।