শিক্ষায় গৃহবধূ রোমানার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
‘এখনকার দিনেও মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করাটা ভালো চোখে দেখেনা সমাজ। অনেকে একে পাপ মনে করছেন। মেয়ে একটু বড় হলেই পাড়ার খারাপ ছেলেদের কুদৃষ্টি পড়বে তাদের ওপর। তাই ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পরই মা আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। বললেন, “মেয়েদের অত বেশি পড়ালেখা করতে হয় না।” মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ঠিক করলাম, স্কুলে যেতে না পারলেও ঘরে পড়ে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে উচ্চশিক্ষা আমি নেবই। দেখিয়ে দেব শিক্ষা পাপ নয়, বরং সমাজকে আলোকিত করার হাতিয়ার।’
যেমন কথা তেমন কাজ। স্কুলে নিয়মিত না যেয়েও ঘরে পড়েই ২০১১ সালে এসএসসি পাস করেন। আগ্রহ দেখে তার বাবা তাকে ভর্তি করালেন কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার মোহাম্মদ পুর সেরাজুল হক কলেজে। কিন্তু এবারও বাঁধা পরিবার ও আত্মীয় স্বজনসহ সমাজের। কলেজে ভর্তির অপরাধে পরিবারকে এক প্রকারে সমাজচ্যুত করলেন বাড়ির লোক ও গ্রামের মাতবরেরা। বাধ্য হয়েই পড়ালেখার ইতি টেনে ২০১৫ সালের ১৭ জুলাই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন রোমানা আক্তার।
গল্পের এখানেই শেষ নয়। বাড়ি ও সমাজচ্যুত একটি গ্রামের মেয়ে এরপর কীভাবে গ্রাম্য পরিবেশে স্বামীর সংসার এক ছেলেকে মানুষ করার পাশাপাশি নিজেও ইন্টারমিডিয়েট এবং বিএ পাস করে চলতি বছর মাস্টার্স শেষ বর্ষে ইসলামের ইতিহাস বিষয় নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে নারীশিক্ষা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হয়ে ওঠেন, আসল গল্পটা সেখানেই।
রোমানার জন্ম ১৯৯৬ সালের ২ জানুয়ারি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার শুভপুর গ্রামে। বাবা আবদুল মান্নান পেশায় একজন বর্গাচাষী কৃষক। স্বামী শরিফুল আলম চৌধুরী একজন ছোট লেখক ও সাংবাদিক। রোমানা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চতুর্থ ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়ে পড়ালেখায় ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রথম দেবীদ্বার আলহাজ্ব জোবেদা খাতুন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে সমাজকর্ম বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হয়েও পড়তে পারেনি। ভেতরে আগুন তাই ছাইচাপা ছিল। ছেলের দেখাশুনা ও পরিবার সামলিয়ে পড়ালেখা করানোর ফাঁকে নিজেকেও প্রস্তুত করেন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য।
২০১৬ সালে একমাত্র সন্তান শালমানকে গর্ভে রেখেই তিনি বিএ পরীক্ষা দেন এবং পাসও করেন দেবীদ্বার সুজাত আলী সরকারী কলেজ থেকে। এরই মধ্যে ২০১৩ সালে উপজেলার ফুলতলী ইসলামিয়া মাদ্রাসা স্থাপিত হলে উদ্যোক্তারা মুসলমান পরিবারের মেয়ের সন্ধান করছিলেন ভর্তির জন্য। সে সঙ্গে নারী শিক্ষিকাও। রোমানাকে ওই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার অনুরোধ করা হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে রোমানা বিনা বেতনে (দুই বছর) প্রাইভেট শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়েন মেয়ে শিক্ষার্থীর খোঁজে। চার ছাত্র ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বর্তমানে প্রায় দুইশ।
এদিকে প্রাইভেট টিউশানি শিক্ষকতার পাশাপাশি ২০১৩ সালে এইচএসসি ২০১৬ সালে বিএ এবং মাষ্টার্স ২০১৮- ২০১৯ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে চলতি বছরে সমাপনী পরীক্ষার পরিক্ষার্থী তিনি । মা-ছেলের একই সঙ্গে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া এবং পাসের খবর এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এরই মধ্যে নারীশিক্ষা এবং নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির কাজও চালিয়ে যান রোমানা। কাজে গতি আনার লক্ষ্যে সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে শতাধিক নারী নির্যাতন ঘটনার নিষ্পত্তি করেছেন তিনি।
২০১৮- ২০১৯ সালে ইসলামি ফাউন্ডেশনের গণশিক্ষা প্রকল্পের সহযোগিতায় তার শ্বশুরালয় কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কাজিয়াতল এলাকার ২৫-৩০ জন নারী নিয়ে শুরু করেন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এরপর সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প সমিতির সদস্য হয়ে প্রায় শতাধিক নারীকে সংগঠিত করে এ সমিতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। গ্রামের সাংসারিক কাজ কর্ম শেষেও কিন্তু শিক্ষার আগ্রহ উদ্যমে ভাটা পড়েনি তার। গ্রামের মেয়েদের সংগঠিত করার কাজটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। বললেন, ‘প্রতি তিন মাস পর মহিলা সমিতির সদস্যদের নিয়ে বাড়িতে বৈঠক করি, তাদের উৎসাহ-পরামর্শ দিই। আমার বিশ্বাস, একদিন সমাজের সব নারী শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, প্রমাণ করবেন মা-বোন ও স্ত্রীর পরিচয়ের পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও একটা পরিচয় তাঁদের আছে।’
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে রোমানার মাষ্টার্স শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা, তিনি সবার নিকট দোয়া চেয়েছেন যেন মার্ষ্টার্সের এ পরীক্ষায় তিনি ভালো ফলাফল করে উত্তীর্ন হতে পারেন।