গানকে সাথে নিয়ে অধ্যাপক হতে চাই!
শেখ শাহরিন সুলতানা মীম পুরো নাম হলেও ক্যাম্পাসের ছোট বড় সবার কাছে মীম নামেই পরিচিত। ক্যাম্পাসের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই মীম প্রিয়মুখ। যেকোন কালচারাল অনুষ্ঠানে প্রথমেই তার ডাক পড়ে। আর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তো থাকেই। সেজন্য সবাই মীম’কে এক নামেই চেনে। গানের পাশাপাশি তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসাহিত্যের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। গানকে সাথে নিয়ে ভবিষ্যতে অধ্যাপক হতে চান তিনি। ক্যাম্পাস ও গানের জীবনের আঁকাবাঁকা পথ জেনে এসে লিখেছেন – অরণ্য সৌরভ
ছোট থেকেই ডানপিটে স্বভাবের মীমের শৈশব কেটেছে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার মহেশপুর গ্রামে খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ, মায়ের বকুনি, সাঁতার কেটে, বড়শি দিয়ে মাছ ধরে, সাঁতার কেটে ও ঢিল ছুড়ে মানুষের গাছের নানান ফল এনে। সন্ধ্যায় বাবার সাথে রোজ বাজারে নাস্তা করতে এসেই ঘুমিয়ে গেলেও, ঘণ্টা দু’য়েক পর জেগে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন।
২০০৭ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখা শুরু করেন। সপ্তাহে দু’দিন দু’জন ওস্তাদের কাছে তালিম নিতেন। তাঁরা যে গান দিয়ে যেতেন সারা সপ্তাহ গুনগুন করার পাশাপাশি অন্যান্য গানও আওড়াতেন। মীমের এমন কর্মকাণ্ডের নজরে রাখতেন সংগীতপ্রেমি নানা আবদুর রশিদ তালুকদার। তিনিই সর্বপ্রথম ‘লালন কন্যা’ নামে ডাকতে শুরু করেন। এছাড়াও মোল্লারহাট জেড এ ভুট্টো ডিগ্রি কলেজের এক অনুষ্ঠানে ওস্তাদ সঞ্জয় কুমার ওঝা নামের আগে ‘লালন কন্যা’ যোগ করে মে আমন্ত্রণ জানান। একবার গান গাওয়া অবস্থায় তার ওস্তাদ প্রণাম করেন বলেন, ‘লালনের গানে তুই অনেক দ‚রে যেতে পারবি।’ এরপরে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এছাড়া একবার উপজেলাতে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাইমুন হোসেন তাকে সংগীতে পুরস্কার দেয়ার আগে এ নামে ঘোষণা করেন। তখন থেকেই মূলত এ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তাছাড়া ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর তার ‘এক চোক্ষেতে হাসন কান্দে আরেক চোক্ষে লালন’ গানটি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়। যেখানে তার বন্ধু উমায়ের ‘লালন কন্যা’ ক্যাপশন দিয়েছিলেন। এরপর মোটামুটি যারাই তার গান ভালবাসেন সবাই লালন কন্যা হিসেবেই ডেকে থাকেন, চিনে থাকেন।
‘লালন কন্যা’ উপাধির অনুভূতিতে মীম বলেন, ‘প্রশংসা, খেতাব উপাধি কার না ভালো লাগে। আমিও ব্যতিক্রম নই বরং নিজ নামের বাইরে আমার আরও একটা পরিচয় আছে তাই এ উপাধিকে পরিচয় হিসেবেই ধারণ করি।’ গানের পেছনে অনুরাগের বিষয়ে মীম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই ঘুমানোর সময় বাবা গান গাইতেন সেখান থেকেই মূলত গানের শুরু।’ ২০০৬ সালে স্কুলের এক অনুষ্ঠানে কিরণ রায়ের ‘গাছের মূল কাটিয়া’ গানটি গেয়ে হারমোনিয়াম বাজাতে না পারার জন্য পুরস্কার পাননি বলে কেঁদেছিলেন তিনি। তারপরেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখা শুরু। লালন বা ফোক গানের প্রতি অনুরাগ নিয়ে মীম বলেন, ‘ফোক গানই তো শেকড়ের গান। মাটি ও মানুষের গান। ব্যথা, বেদনা, সুখ দুঃখের ভীষণ সুন্দর মিশ্রণের নামই তো ফোক গান। তাই ফোক গান ধারণ করতে চাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘দাদাবাড়ি কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়াতে হওয়ায় বছরে দু’বার অন্তত যাওয়া হত। আর কুষ্টিয়া গেলে লালনের আখড়াতে অবশ্যই যেতাম। সেখানে দেখতাম গানের আসর বসত, বাউলদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও গান করতে পারেন। একবার আখড়াতে যাওয়ার পর কাঙ্গালিনী সুফিয়ার সাথে ‘ধন্য ধন্য বলি তারে’ গেয়েছিলাম। এরপর থেকেই লালনের গানে নিজেকে আরো জড়িয়ে নিলাম।’
‘লালনের মেলা হয়। কিন্তু বাউলদের মেলা হয় না। সেই মেলায় অনেক বাউলই আসতে পারে না। প্লাটফর্ম পায় না। যদি কোনদিন সুযোগ হয় তবে বছরে একবার অন্তত বাউলদের নিয়ে মেলার আয়োজন করব। সবাই আসবে, গান করবে। নতুনদেরও আগমন ঘটবে এবং একটি প্ল্যাটফর্ম পাবে।’ লালনের গান ও বাউলদের নিয়ে এমন পরিকল্পনার কথাই জানান মীম।
লালন কন্যা খ্যাত মীমের জীবনের অর্জনের ঝুড়িটা ভরপুর। ২০০৮ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় উপজেলায় মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেন। এছাড়াও জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় উপজেলা, জেলা এবং বিভাগ পর্যায়ে একাধিকবার পুরস্কার পেয়েছেন। তাছাড়া ২০১৫ সালে চ্যানেল আই’র তারায় তারায় দীপশিখা অনুষ্ঠানে সারাদেশে তৃতীয়, ২০১৭ সালে উপজেলায় শ্রেষ্ঠ সংগীত শিল্পী হিসেবে সংবর্ধনা, বৈশাখী টিভিতে পদ্মকুঁড়ি অনুষ্ঠানে পরপর দু’বার বরিশাল বিভাগে ফার্স্ট প্রথম এবং বাংলার গান, ক্ষুদে গানরাজ, পাওয়ার ভয়েজ, মার্কস অলরাউন্ডার বরিশাল বিভাগ থেকে ইয়েস কার্ড অর্জন করেছিলেন। ২০১৮ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় ৩৭টি পাবলিক ভার্সিটির মধ্যে ফোক গানে তৃতীয় হওয়ায় ইবিতে দুই দুইবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার বরিশালের লালনগীতির তালিকাভুক্ত শিল্পী, ২০১৩ সালে বিটিভির বৃত্তের বাইরে অনুষ্ঠানে দেশের গানের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। এছাড়াও চ্যানেল আই, মাছরাঙা টেলিভিশনে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন।
অনুপ্রেরণার উৎসের মুকুটটা তিনি বাবার মাথায় পড়াতে চান। কারণ তার বাবা বরাবরই গান প্রিয় মানুষ। গান সম্পর্কিত প্রোগ্রাম কিংবা প্রতিযোগিতার সব তথ্য বাবার কাছেই পেয়ে থাকেন এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়, সংগীতের অনুষ্ঠানে নিজে সাথে করেও নিয়ে যেতেন। ‘দর্শকদের ভালবাসায় এতটা পথ পাড়ি দিয়েছি। তাদের কাছে একটাই চাওয়া এভাবে ভালবেসে পাশে থাকবেন এবং শুদ্ধ গানের সাথে থাকবেন।’ দর্শকশ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তিনি এ কথা বলেন।