ওয়ান্ডার উম্যান ১৯৮৪ : কমিকবুক ফিল্ম নাকি ফিল্মে কমিকবুক?
প্রথমে যে কথাটা বলে নেয়া উত্তম, তা হল, আইএমডিবিসহ সকল জায়গায় এরকম ধ্বস দেখে স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ দর্শক খুব একটা আশা নিয়ে দেখতে বসবেন না। অনেকে হয়তো সিনেমাটাকে অবহেলা করে অন্য কোন একটা ফিল্ম দেখা শুরু করবেন। এটা খুবই অনুমিত একটা বিষয়। ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের ফিল্মে খুব একটা আশা রাখা যে ঠিক নয় এমনিতেও, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ডার্ক নাইট ট্রিলজি, ওয়াচমেন, ভি ফর ভ্যানডেটা, জোকার কিংবা ডিসি কমিক্সের অ্যানিমেটেড ফিল্মগুলো যেরকম উপভোগ্য, তাদের এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের ফিল্মগুলোর বেশিরভাগ ততটাই হতাশাব্যাঞ্জক। তবে এই কম প্রত্যাশা নিয়ে দেখতে বসার ফলাফল মাঝেমধ্যে ভালোই আসতে পারে সৌভাগ্যক্রমে।
প্রশ্ন যদি হয় 'ফিল্মটা কেমন?', তবে উত্তর হবে যে ভালোই বা চলনসই। মানে যেরকম মন্তব্য আসছে বেশিরভাগ দর্শকের কাছ থেকে, তার তুলনায় অনেক ভাল। কিন্তু প্রশ্নটা যদি হয় "একক সুপারহিরো মুভি হিসেবে কেমন?" – তখন উত্তরটা বাকি সবার মত এত খারাপ না হলেও কাছাকাছি যে যাবে, এটা সত্য। প্লটটা খুবই ভাল ছিল, মানে সত্যিকার অর্থে যে দর্শনটা তুলে ধরতে চাওয়া হয়েছে, সেটা আসলে ভাবার মতই একটা বিষয়।
কিন্তু দুর্বল গল্প বলার ধরণ আর ভজঘট পাকিয়ে ফেলা ঘটনাপ্রবাহ এই প্লটটার সঠিক ব্যবহার করতে পারেনি। সম্ভবত সিনেমাটির হর্তাকর্তারা চেষ্টা করেছেন একটা ক্লাসিক দার্শনিক মতবাদের মধ্যে কমিকবুকের নায়কোচিত চরিত্রদের কোনভাবে প্রতিস্থাপন করে দিতে, কিন্তু আদতে সেটা কাজে আসে নি। যদি গল্পের ধারাটা খেয়াল করা হয়, তবে মনে হবে যে এটাকে জোর করে সুপারহিরো ফিল্ম না করে আলাদাভাবে একটা ফ্যান্টাসি-ড্রামা ঘরানার সিনেমা করলেই সম্ভবত ভাল হত। তখন গল্পের উপরেই জোর দেয়া যেত, নায়কোচিত চরিত্ররা গল্পের স্রোতেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠতো, আলাদাভাবে মহিমান্বিত করার প্রয়োজন হত না। কিন্তু ফিল্মটা ওয়ান্ডার উম্যান এর হওয়াতেই মূলত ঝামেলাটা হয়েছে, চরিত্রটির 'সুপারহিরো' সুলভ তাৎপর্য দেখানোর চেষ্টাটা বারবার জোর করে টেনে আনার মত মনে হয়েছে। এর ফলে মূল গল্পের ক্রমবিকাশ পরিপূর্ণ হয় নি, চরিত্রের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার মুহূর্তগুলো হঠাৎ করেই খাপছাড়া হয়ে গেছে।
মূলধারার কমিকবুক ফিল্মের বেশিরভাগ দর্শকশ্রোতার কাছ থেকে একটা সাধারণ অভিযোগ শোনা যাচ্ছে যে "অ্যাকশন কম ছিল" – এইখানেই উল্লেখ করার মত একটা ব্যাপার আছে। যেরকম গল্প, সেটা মোটেই 'সুপারহিরো' সুলভ অ্যাকশন আনার মত না। হয় ওয়ান্ডার উম্যানের সুপারহিরো সত্তা, নইলে এই ফিল্মে ডায়ানার মূল দর্শন, দুইটার যেকোন একটা নিয়ে এগোনো উচিত ছিল, দুটো মেশাতে গিয়ে একটা অসফল খাদ্য প্রণালীর মত হয়ে গেছে। মানে, সিনেমাটায় সকল মসলাই উপস্থিত, কিন্তু সেগুলোর যথোপযুক্ত মিশ্রণ ঘটে নি, সব কেমন যেন একেক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । এই যেমন, প্রধান ভিলেন ম্যাক্স লর্ডের চরিত্র গঠনের দিকটা একদমই পরিষ্কার করা হয় নি। চিতার মত সুপরিচিত এক চরিত্রকে কিছুটা ভিত্তিহীন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুপারহিরো বা কমিকবুক ফিল্মের ক্ষেত্রে এটা বেশ বড় একটা দুর্বলতা।
ফিল্মের কালার গ্রেডিং ভাল ছিল। ১৯৮৪ সালের গল্প হিসেবে তৎকালীন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কিছু ছোটখাটো দিক তুলে ধরা হয়েছে। সবচেয়ে ভাল ছিল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর সাউন্ড মিক্সিং৷ কিছু কিছু জায়গায় ক্যামেরার কাজ ভাল হয়েছে, কিছু জায়গায় হয় নি। শেষের দিকের ক্যামেরার কাজগুলো দৃষ্টিনন্দন ছিল, অনেকটা ক্লাসিক ক্রিসমাস ফিল্মের মত। সব মিলিয়ে প্রযুক্তিগত কাজগুলো যত্ন নিয়েই করা বলে মনে হয়েছে। তবে এর বাইরে অভিনয়ে কিছুটা ঘাটতি আছে। সিনেমার স্থিতিকাল একটু বেশি কিন্তু সেটা কোন ব্যাপার না। পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়, ডিসিইইউ এর উচিত নিজেদের নিজস্ব পরিকল্পনায় এগিয়ে চলা। এখনো উন্নয়নের সময় আছে, তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী 'মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স' অনেক দূরে চলে গেছে দেখে জোর জবরদস্তি করে ডিসিইইউ এরও সব চরিত্র এনে 'টিম আপ' করানোর কোন প্রয়োজন নেই এখনি। সবার আগে দরকার গল্পের মাধ্যমে উপযুক্ত চরিত্র গঠন, সেখানেই আগে নজর দিলে ভাল হয়।
অনেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন যে ফিল্মটা দেখলে সেটা সময় নষ্ট করা হবে কিনা। এটা আসলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। তবে আমি বলবো যে অবশ্যই দেখবেন৷ সিনেমার দর্শক হতে হলে শুধু সেরা সিনেমাগুলোই দেখতে হবে এরকম কোন কথা নেই। এমন সব সিনেমাও দেখুন যেগুলো নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করার কিছু বিষয়বস্তু পাওয়া যাবে। এতে করে আপনি একসময় নিজেই আবিষ্কার করবেন যে একটা সিনেমা বুঝে দেখার দক্ষতার কতটা উন্নতি হয়েছে আপনার মাঝে!