আত্মহত্যা: সামাজিক দায় এবং দায়িত্ব
মরিতে চাই না আমি এই সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচতে চাই, কবিগুরুর এই বাক্যকে উপেক্ষা করে অনেকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার ঘটনাগুলো ঘটছে হারহামেশাই। কেউ বিষ খেয়ে, কেউ মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে, কেউ গলায় ফাঁস দিয়ে আবার কেউবা নীরবে সূক্ষ্মভাবে শেষ করে দিচ্ছে নিজের সুন্দর জীবনকে। উত্থান-পতন, জয়–পরাজয় জীবনে থাকবেই। কিন্তু ক'জন ই বা পারে সেসব উত্থান-পতন মেনে নিয়ে পৃথিবীতে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে? হতাশার কাছে হার মেনে এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে যারা অন্ধকার জগতের নিমিত্তে পাড়ি জমান তারা কি আসলেই স্বার্থপরের মতো সবাই কে কাঁদিয়ে চলে যায়? নাকি এ বিষাক্ত সমাজ থেকে চিরতরে মুক্তি পেতে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ?
এসবের সূক্ষ্ম সমাধান পাওয়া কখনো সম্ভবপর হয়ে উঠে না। তবে এটুকু নিশ্চিত যে মানসিক অতীতের করুণ ইতিহাস থেকেই ঝুলে যায় সত্ত্বা। সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ আত্মহত্যা করলেও কিশোর-কিশোরী ও যাদের বয়স ৩৫ এর নিচে তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। যারা আগামীতে নেতৃত্ব দিবে দেশকে, এগিয়ে নিয়ে যাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কে অথচ তারাই নিমজ্জিত হতাশা নামক অন্ধকারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর মতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ আত্মহত্যা। বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে কোথাও না কোথাও আত্মহত্যা করে থাকে এবং প্রতিবছর ১০ লাখেরও অধিক আত্মহত্যা করে নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে। তবে নারীদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। যা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৪ জন এবং বছরে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। আবার আত্মহত্যা অঞ্চলভেদেও কম-বেশি হয়ে থাকে বলে জানান তারা। সেক্ষেত্রে ঝিনাইদহ সবার উপরে রয়েছে। সেখানে প্রতিবছর প্রায় তিনশর অধিক আত্মহত্যা করে। এছাড়া শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে আত্মহত্যার হার ১৭ গুণ বেশি। একজন মানুষের আত্মহত্যার পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকলেও শিক্ষাজীবনে ভাল রেজাল্ট না হওয়া, চাকরি না পাওয়া বিশেষকরে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষার পরে বিসিএস বা সরকারি চাকরি-কেন্দ্রিক হতাশা, প্রেমে ব্যর্থ, যৌতুক সমস্যা, দাম্পত্যকলহ এবং ধর্ষণ উল্লেখযোগ্য।
আত্মহত্যার বিষয়টি যতটা মানসিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঠিক ততটাই পারিবারিক বা সামাজিক। সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানীদের সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মনে করে- প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা সমাজ, সংস্কৃতি এবং সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। একজন মানুষের আত্মহত্যার পিছনে আমরা পারিবারিক বা সামাজিক দায় কখনোই এড়াতে পারি না। একজন ছাত্র যখন পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়, জিপিএ ৫ বা সিজিপিএ ভাল না করে অথবা গ্রাজুয়েট শেষে চাকরি না পায় তখন পরিবার থেকে তাকে নানা কটু কথা শুনতে হয়, সমাজ থেকে শুনতে হয় উপহাসমূলক বিভিন্ন বাণী।
সর্বোপরি একদিকে ভালো রেজাল্ট বা চাকরি না পাওয়া অপরদিকে পরিবার ও সমাজের মানসিক টর্চার তাকে হতাশায় নিমজ্জিত করে ফেলে। যার ফলে অনেকক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। আবার কোন নারী যৌন হয়রানির স্বীকার হলে বা যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হলে এ সমাজ ভুক্তভোগী নারীকে মানসিক সাপোর্ট না দিয়ে, প্রতিবাদ না করে বরং তাকেই দোষারোপ করতে থাকে।
আবার অনেকে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ফেসবুকে যখন আবেগঘন স্টাটাস দেয় তখন তার নিজের বন্ধুরাই তাকে মানসিক সাপোর্ট না দিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। ফলে ভুক্তভোগী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে যার দরুন এরকম অহঃঅহ আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটে যাচ্ছে। এ দায় কিন্তু আমাদের সমাজের। আমরা যদি পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া বা চাকরি না পাওয়া বেকার ছেলেটিকে কটু কথা বা উপহাসের পরিবর্তে অনুপ্রেরণা দিতাম, ভিন্ন কোন পথ দেখাতাম তাহলে গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো। যৌতুক বা ধর্ষণের কারণে নির্যাতিত সে নারীর পাশে দাঁড়াতাম অথবা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ছেলেটা যখন হতাশায় ভুগছিল তখন তাকে মানসিক সাপোর্ট দিতে পারতাম, তার পাশে থাকতাম তাহলে হাজারো হতাশার মাঝে নতুন করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজত তারা।
জীবনে সমস্যা রয়েছে বলেই জীবন এত সুন্দর। সমস্যা না থাকলে মানুষ নতুন করে নতুন রূপে নিজেকে কখনো আবির্ভাব করতে পারতো না। সমস্যা যেমন রয়েছে তেমনি সমস্যার সমাধানও রয়েছে। তাই জীবন কে ভালবেসে এগিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। বহির্বিশ্বের দেশ গুলোতে দেখা যায় তারা হতাশা থেকে বাঁচার জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে শিক্ষার্থী ও যুবক-যুবতীদের জন্য বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করে তাদের নতুনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখানো হয়, হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সংঘটন রয়েছে । আমাদের দেশেও এরকম করা উচিত। সরকারের পক্ষ থেকে যুবকদের জন্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, চাকরির পিছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হতে সরকারি ও বেসরকারি প্রণোদনা দিতে হবে।
সমাজের মানুষদের উচিত একজন বেকার, ধর্ষিতা ও নির্যাতিত নারীদের উপহাস বা নেতিবাচকভাবে না দেখে সমাজে ইতিবাচক চোখে দেখতে হবে। তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করতে হবে। জীবন চলার ভিন্ন পথ দেখাতে হবে। ফেসবুকে কোন বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় স্বজন হতাশায় ভুগলে তাকে নিয়ে ট্রল না করে গুরুত্বের সাথে তাকে দেখতে হবে, মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে, বেঁচে থাকার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। সর্বোপরি সমাজে নৈতিক ও ধর্মীয় চর্চার লালন করতে হবে। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিকেও ভাবতে হবে আত্মহত্যা কোন সমাধানের পথ নয়। ভাবতে হবে তার নিজের পরিবারের কথা, নিজের সমাজের কথা, নিজের দেশের কথা। তাকে মনে রাখতে হবে এ পরিবার, সমাজ এবং দেশ থেকে তুমি কি পেয়েছ তা বড় নয়। তুমি এ পরিবার, সমাজ এবং দেশ কে কি দিতে পেরেছ বা পারছ সেটাই বড়। এভাবে আমাদের মানসিকতা, সামাজিকতা, সংস্কৃতি এবং সামগ্রিক পরিবর্তনই পারে একটি সত্ত্বার অকালে ঝরে যাওয়া রোধ করতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত