ভিখারি বুড়ি মা
রমেশ বাবুর চায়ের দোকানে সেদিন, সুদীপ স্যার, সৌমেন কাকু ও সুকেশ জ্যেঠু তাসের আড্ডায়, বাজি ধরা খেলাতে প্রতিবারের মতো এবারে ও বেশ তর্কযুদ্ধ চলছিল। ওই সময় হঠাৎ এক ভিখারি বুড়ি মা রমেশ বাবুর চায়ের দোকানের কাছে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বললো, ‘বাছা, কাল থেকে পেটে একমুঠো খাবার জোটেনি, অন্যের দরজায় দরজায় কত ঘুরেছি, কেউ একবারও খেতে বলেনি, পেটে খিদের জ্বালা! কিছু খাবার দিবি?’
হঠাৎ সকলে চুপ! সুদীপ স্যার বললেন, বুড়িমা কোথায় থেকে আসছেন? বুড়ি মা কিছুক্ষণ চুপ, তার পর সুকেশ জ্যেঠু বললেন, ‘ও বুড়িমা কোথা থেকে আসছেন?’ তখন বুড়ি মা বললেন, ‘বাছা কানে একটু কম শুনি, জোরে না বললে শুনতে পাই না! বয়সটাও কম হলো না যে!’
সেদিন রমেশ বাবুর চায়ের দোকানে সবার মনে একটা মানবিকতা জেগে উঠেছিল। সুদীপ স্যার বললেন, দেখেছ সৌমেন মানুষ কত স্বার্থপর হয়? সৌমেন বললো, একদম ঠিক কথা বলেছেন। সবাই একটা বিস্ময় নিয়ে ভিখারি বুড়ি মার দিকে তাকিয়ে থাকলো। রমেশ বাবু বুড়িমাকে দোকানের ভেতর ডেকে চা ও বিস্কুট খেতে দিলেন। এদিকে তাসের আড্ডায় কারও আর মন বসলো না। সবাই বুড়ি মা’র কাছে এসে বসলো। সবাই জানতে চায়, কেন তিনি শেষ বয়সে ভিক্ষা করছেন? ও বুড়িমা আপনার কি কোনো আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-মেয়ে নেই? বুড়ি মা চা খাওয়া শেষ করলেন। সবার আগ্রহে তিনি সায় দিয়ে বললেন, ‘বাছা, তোমরা আমার জীবনের ঘটনা শুনতে চাও?’ সবাই একসঙ্গে বললো, ‘হ্যাঁ বুড়ি মা’!
বুড়ি মা তার জীবনে ঘটে যাওয়া নির্মম পরিণতির কথা জানাতে শুরু করলো। বুড়ি মা বললেন, ‘বাছা, আমার বাড়ি মহেশপুর গ্রামে। এখান থেকে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার দূরত্ব। আমার এক ছেলে ছিল তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ও দেখেছি। কিন্তু ভগবান সেই সুখ আমার কপালে বেশি দিন রাখেনি। ছেলের বয়স তখন মাত্র তেরো বছর হঠাৎ একটা পথ দুর্ঘটনায় ছেলেটা মারা যায়। তখন সংসারে আমরা তিন জন ছিলাম। আমাদের পরিবারটা শেষ হয়ে গেলো, ছেলের চিন্তায় সবসময় মনটা বিমর্ষ হয়ে থাকতো। এভাবে বছর তিনেক কেটে গেলো। তারপর হঠাৎ একদিন স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো। সংসারটা ভেসে গেলো, ‘সুখ তুমি কত নিদারুণ পরীক্ষা নিলে আজ আমার সংসারটা খালি করে!’
পাড়া প্রতিবেশীরা প্রথমে আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। এভাবে কোনোমতে টেনেটুনে দিন চলছিল। প্রকৃতি কত নিষ্ঠুর? হঠাৎ বন্যার জলে মহেশপুর গ্রাম সব জলের তলায় তলিয়ে গেলো। বাঁচার আর কিছু অবশিষ্ট রইলো না বাছা। তারপর পেটের যন্ত্রণায় এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করি।
রমেশ বাবুর চায়ের দোকানে সুদীপ স্যার বললেন, বড়ই নিষ্ঠুর পরিণতি। সবাই মাথা নাড়লেন। সবাই দেখতে পেলো বুড়িমার হাসির আড়ালে কত যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। দু-চোখ দিয়ে অশ্রু বন্যা বইতে চাইতে। মনে হয় কোনো একটা আঘাত চোখের শুকনো জল কোটরে শুকিয়ে শুকিয়ে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে! আজ বুড়ি মা’র জীবন পাথরের আঘাতে নিরুত্তর থেকে গেছে। রমেশ বাবুর চায়ের দোকানে সুকেশ জ্যেঠু বললেন, ‘আচ্ছা সুদীপ আমাদের বাড়ির বাম পাশে একটা খালি ঘর পড়ে আছে, ওখানে বুড়িমাকে রাখলে কেমন হয়?’ সবাই উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠলো বললেন, ‘খুব ভালো হবে সুকেশ জ্যেঠু বুড়িমা তো আমাদের মায়ের মতো!’ এই কথা শুনে বুড়ি মা’র দু-চোখ অশ্রুতে ভরে গেলো। বললেন, ‘বাছা আজ থেকে তোমরা আমার ছেলে!’
অনন্যা/এসএএস