সাইবার বুলিং রোধে অভিভাবকের সচেতনতার বিকল্প নেই
যে কোনো ভালোর উল্টো পিঠে খারাপ থাকে। তবে সে খারাপের প্রভাব থেকে সমাজকে মুক্ত রাখতে পারাটাই সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।
তেমনি দেখা যাচ্ছে বিশ্বায়নের উৎকর্ষতায় উপচেপড়া সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তি অনেক বেশি মানুষের হাতের নাগালে চলে আসায় সাইবার বুলিং-এর মত একটি গুরুতর সামাজিক অপরাধের কবলে পড়তে হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে।

সাইবার বুলিং’ হচ্ছে অনলাইনে কোন মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো ও মানসিক নির্যাতন করা। শুরুতে টিনএজাররাই কেবল এ ধরণের কাজে জড়িত থাকে ভাবা হলেও পরে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে স্বনামে বা ফেইক আইডির আড়ালে প্রাপ্তবয়স্ক অনেকেও এ ধরণের হীন কাজে জড়িত থাকেন।
এছাড়া সাইবার বুলিং-এর ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটলেও ফোনে কিংবা ইমেইলেও অনেক সময় এ ধরণের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে।
বর্তমান সময় সাইবার বুলিং এক জঘন্য রূপ ধারণ করেছে। সাধারনত অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর-কিশোরী ও নারীরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। সেদিক থেকে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে সাইবার বুলিংয়ের সর্বোচ্চ আক্রমণের শিকার হচ্ছেন নারীরা। সাইবার বুলিংয়ের প্রভাব মাদকের মতোই ভয়াবহ। এথেকে প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নানান ধরনের সমস্যা। এমনকি এটির কারণে নারী পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে, সমাজে তাদের গুরুত্ব থাকছে না, অনেক সময় আত্মহত্যার ঘটনা শোনা যায়।
বিভিন্ন ধরনের ফটো এডিটিং সফটওয়্যার দ্বারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে সংগ্রহীত ছবি এডিট করে সামাজিক ভাবে হেয় করা হয় মেয়েদের। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সারা পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী নারীদের ২০% সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোশ্যাল বুলিং এর শিকার হয়।
তবে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে সাইবার বুলিং এর শিকার হওয়ার পর সমাজের অজ্ঞ মানুষদের কোনভাবেই বোঝানো যাচ্ছে না যে, যারা সাইবার বুলিং এর শিকার হয়েছে তাদের কোন দোষ নেই! অথবা সে এই ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত নয়।
আমাদের সমাজে সাইবার বুলিং সম্পর্কে খুব বেশি সচেতনতা তৈরি হয়নি। যে কারণে অনেকেই হয়তো জানেন না সাইবার বুলিং কী? কীভাবে এটি সংঘটিত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কী ধরনের মন্তব্য করলে সেটি সাইবার বুলিংয়ের আওতায় পড়ে সে বিষয়টিও আমাদের অনেকের জানা নেই। কেউ যখন নেতিবাচক মন্তব্য করেন, তখন অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন এটি তার মানসিক সমস্যা। কিন্তু নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নেতিবাচক ধারণা শুধু মানসিক সমস্যাই নয় এটি গুরুতর একটি অপরাধ।
যে মানুষটিকে সাইবার বুলিং এর লক্ষ্যবস্তু বানানো হয় তার মধ্যে দেখা যায় এমন ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে সে নিজেকে আর সক্রিয় , আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনে করে না। বরং এক সময় নিজে কে ঘৃণা করা শুরু করে। মূলত তার আত্মবিশ্বাসকে একদম গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। আর এটাই বুলিং এর সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক।
আমাদের পরিবারের ছোটরা সাইবার দুনিয়ার কতটা ইতিবাচক দিকের সাথে মিশছে সেটি দেখার দায়িত্ব রয়েছে পরিবারের বড়দের। কিন্তু কোনোকিছু দেখভাল করার আগে সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন আছে।
নব্বইয়ের দশকের পূর্বে কিংবা বিংশ শতাব্দি ও এর পরেও বেশকিছুদিন ইন্টারনেট সম্পর্কিত প্রযুক্তিগুলোর তেমন ব্যবহার ছিলো না। তাই সে সময় থেকে শুরু করে তার পূর্বের মানুষরাও এর সাথে তেমন পরিচিত নন। অথচ তাদের পরিবারের ছোট সদস্যরা সাইবার সেবা থেকেও পিছিয়ে থাকছে না। কিন্তু ইন্টারনেটবিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতা থেকে এই অভিভাবকরা অনেকটা পিছিয়ে।
কিন্তু অভিভাবক হিসেবে সন্তানের ভালোর জন্যই তাদের সাইবার জগতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি অনন্য দায়িত্ব। এজন্য সাইবার বিষয়ে তাদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।
অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন, সন্তানদের একটা কম্পিউটার বা মোবাইল দিলেই তারা লেখাপড়া শিখে ফেলবে। কিন্তু তারা জানে না যে, এসব ডিভাইস তাদের জন্য কত বড় সমস্যা নিয়ে আসতে পারে। তাই এর ব্যবহার সম্পর্কে অভিভাবকদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বেশির ভাগ অভিভাবক জানেন না, অনলাইনে তার সন্তান কার সঙ্গে মেশে, কী ধরনের তথ্য শেয়ার করে। অভিভাবকদের অসচেতনতায় শিশুরা খুব সহজে সাইবার বুলিং এর মত অনেক বড় অপরাধের শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে তাদের তদারক করা প্রয়োজন এবং এ থেকে রক্ষায় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।

অনেক সময় সাইবার বুলিংয়ের ক্ষেত্রে চুপ থাকার একটি প্রবনতা থাকে ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে। অথচ এই প্রবনতাটাই বড় ক্ষতির অন্যতম কারণ। পরিবারের কথা ভেবে কিংবা সম্মান হারানোর ভয়ে অনেকেই সব চুপচাপ সয়ে যান কিংবা চেপে যান। অপরাধীরা এর ফলে আরও বেশি সুযোগ নেয়।
এক্ষেত্রে তাদের মা-বাবা যদি সহজেই সন্তানের বন্ধু হতে পারে তাহলে এ সংকট মোকাবিলা একদমই কঠিন নয় কারো কাছে। সাইবার বুলিং কী, ভার্চুয়াল জগতের পরিচিতরা কেন অনিরাপদ এবং একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য কেন সবার সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না এগুলো সন্তানদের শেখানো কিন্তু বাবা মায়ের দায়িত্ব । ভার্চুয়াল জগতে সন্তান কোন মাঠে খেলছে সেদিকে নজর দিতে হবে তারই সঙ্গী হয়ে। এ জন্য গণসচেতনতা তৈরির আর কোন বিকল্প নেই।