যুক্তরাজ্যে বেতনকাঠামো: নারীর প্রতি বৈষম্য
যুক্তরাজ্যে সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে দেশটিতে ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে নারীর চেয়ে পুরুষের বেতন বেশি! অর্থাৎ ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেই নারীরা বেতন বৈষম্যের শিকার। বৈষম্য কমিয়ে আনতে নানাবিধ পদক্ষেপ গৃহীত হলেও বাস্তবে তা পরিদৃশ্যমান নয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেতন ব্যবধান ১২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১৭-১৮ এই সময়ে ব্যবধান ছিল ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। গত বছরের চেয়ে চলতি বছরের বেতন বৈষম্য অপরিবর্তিত।
শুধু যুক্তরাজ্য কেন, নারী-পুরুষের বৈষম্য দেশ-কাল-স্থানভেদে সর্বত্র একই। যতই জাতি হিসেবে শিক্ষা-দীক্ষা এবং আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিপুষ্ট হোক না কেন, নারীর প্রতি বৈষম্য চিরন্তন। সর্বক্ষেত্রে নারীকে অবমূল্যায়নও করা হয় সবচেয়ে বেশি। একই প্রতিষ্ঠানের সমপদ-মর্যাদার পুরুষের চেয়ে নারীর পারিশ্রমিক কম। এমনকি পুরুষের প্রতি যতটা শ্রদ্ধায় বিগলিত হয় সাধারণ ঠিক ততটাই রুষ্ট হতে দেখা যায় নারীর প্রতি। যেন নারী মাত্রই তাকে কিছু কটুকথা শুনিয়ে দিতে মুখিয়ে থাকে এ সমাজ।
নারীরা কাজে যোগদানের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন আরও বেশি। কিন্তু এই দীর্ঘ ছয় বছরের ফলাফল যুক্তরাজ্যের নারীদের পিছিয়ে পড়াকে ঈঙ্গিত দিচ্ছে।
শুধু আমাদের সমাজেই নারীরা অবহেলিত-নির্যাতিত ও বৈষম্যের শিকার তা নয়। বরং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশগুলোতেও নারীরা নানামুখী নির্যাতনের শিকার। যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও নারীকে অবমূল্যায়ন করা হয়। নারী তার যোগ্য সম্মান-পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হন কর্মক্ষেত্রে। নানা তৎপরতাও এই লিঙ্গভেদ কমেনি। সভ্য জাতি হিসেবে যারা বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিত এমনকি বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে যারা শাসন- শোষণ করেছে তারা আজও নিজেদের মানসিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। যদিও আজও পুরো বিশ্ববাসীর কাছে যুক্তরাজ্য রোলমডেল হিসেবে চিহ্নিত। সভ্যতার ছোঁয়া যাদের বহু আগে স্পর্শ করেছে, সেই সভ্য জাতির গহীনে তলিয়ে গেছে নারীকে মূল্যায়ন করার মানসিকতা! যে মুখোশের আড়ালে নারীর সঙ্গে চলে উৎপীড়ন- অবহেলা- অবমূল্যায়ন।
আবারও যুক্তরাজ্যের বেতন কাঠামেরা দিকে ফিরে তাকানো যাক। দেশটির এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ৭৯ দশমিক ৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেই বেতন কাঠামোয় বৈষম্য। প্রতিষ্ঠানগুলো পুরুষ প্রার্থীর ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। এ বৈষম্য হতাশ করেছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠন ও বেতনের সমতায় ক্যাম্পেইন করা সংস্থাকে। ‘প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করে তারা লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার ফলাফলে স্পষ্ট হয়েছে তাদের ব্যর্থতা।’
পরিবহন ও প্রশাসনে বেতন বৈষম্য বেড়েছে। তবে শিক্ষা খাতে ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০২২-২৩ মৌসুমে এ খাতে গড় বৈষম্য ছিল ২৩ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থনৈতিক খাতের অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। চলতি বছরে এ খাতে গড় ব্যবধান ২২ দশমিক ৭ শতাংশ। পুরো অর্থনৈতিক খাতের মধ্যে ব্যাংকেই বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। সেখানে লয়েড ব্যাংকিং গ্রুপে ব্যবধান ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ ও ন্যাটওয়েস্ট গ্রুপে ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ। এইচএসবিসিতে ২০১৭-১৮ সালে বেতন বৈষম্য ছিল ২৯ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যাংকগুলো স্বীকার করেছে, উচ্চপদগুলোয় নারীদের উপস্থিতি তুলনামূলক অনেক কম। ফলে সার্বিকভাবে বৈষম্য আরো প্রকটভাবে দৃশ্যমান। বৈষম্য কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছে ন্যাটওয়েস্ট ও এইচএসবিসি ব্যাংক। এদিকে ল ফার্মগুলোয়ও বৈষম্য বিরাজমান।
নারী- পুরুষের বৈষম্যের জেরে ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্য লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে আনতে নানা তৎপরতা গ্রহণ করলেও চলতি বছরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে হতাশাজনক তথ্য। যা বিশ্লেষকদের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এভাবে নারী এবং পুরুষের বৈষম্যের ফলে সমাজে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা দেখা দিতে পারে। নারীরা কাজে যোগদানের ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন আরও বেশি। কিন্তু এই দীর্ঘ ছয় বছরের ফলাফল যুক্তরাজ্যের নারীদের পিছিয়ে পড়াকে ঈঙ্গিত দিচ্ছে।
তবু নজরুলের ভাষ্যেই বলতে চাই, ‘সেদিন সুদূর নয়/ যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!’
তাদের উৎসাহ, কর্মদ্যোম বাড়াতে প্রয়োজন লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজ। যা দিতে ব্যর্থ এ রাষ্ট্র। তবে যুক্তরাজ্যের নারীর প্রতি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দেশটির অর্থনীতির ওপরও প্রভাব ফেলবে। কারণ নারী এবং পুরুষের সম্মিলিত শক্তিই একটি রাষ্ট্রের জন্য সমান জরুরি। সেখানে পুরুষেরা যদি এগিয়ে যায় তাহলে নারীর জন্য চরম বিড়ম্বনা সৃষ্টি হবে। নারীরা তাদের যোগ্য মূল্যায়ন না পেয়ে কাজে আগ্রহ যেমন হারিয়ে ফেলবে তেমনই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তাদের যোগদান কমে আসবে। ফলে সামাজিক – রাষ্ট্রিক উভমুখী সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য বেতন বৈষম্য দায়ী হবে।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, যুক্তরাজ্যে দক্ষ নারীর ঘাটতি নেই। তারা উচ্চপদগুলোর দায়িত্ব নিতে সক্ষম। যদি নির্বাচন প্রক্রিয়ার পক্ষপাত দূর করা যায় তবে নারীরা এগিয়ে যাবে। নতুবা নারীর প্রতি যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে সমাজে তা আরও প্রকট হয়ে দেখা দেবে। তাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা। যাতে নারী-পুরুষের লৈঙ্গিকবৈষম্যে নারীরা অবমূল্যায়নের শিকার না হন।
অধিকাংশ সেক্টরে বাংলাদেশেও নারীর তুলনায় পুরুষের মূল্যায়ন বেশি। সে হোক কর্মে বা জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে। কিন্তু একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন, নারী-পুরুষের এই বৈষম্য সমাজ- দেশ- রাষ্ট্রের জন্য কতটা ইতিবাচক!
একদিনে আবহমানকাল ধরে চলে আসা বৈষম্যকে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। তবে এর প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে সূদুর ভবিষ্যতে অবশ্যই পৃথিবীর বুক থেকে নারী-পুরুষের লৈঙ্গিকবৈষম্য দূর হবে। কী তা যুক্তরাজ্য বা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, অনুন্নত দেশ মূলত সব দেশেই এই বৈষম্যের জালে নারী বন্দী। যা দেশকে কয়েকধাপ পিছিয়ে দিয়েছে। তবু নজরুলের ভাষ্যেই বলতে চাই, ‘সেদিন সুদূর নয়/ যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!’