Skip to content

৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মায়ের জন্য

‘ বলো বলো রে বলো সবে
বলো রে বাঙালির জয়
বাংলাদেশের নদীর বুকে এই বলি গান গাহিয়া যায়..’
আমার মায়ের বড় প্ৰিয় গান ছিল।

আমার বাবা-মায়ের বিয়েতে জ্যঠামশাই যৌতুক চেয়েছিল, একটা হারমোনিয়াম
ছোট কাকা পাড়ায় পাড়ায় গান করে বেড়ায়।

মামাবাড়িতে গানের পরিবেশ ছিল,
আমার মা আর দুই মাসী চট্টগ্রামে পটিয়া কলেজে, হস্টেলে থেকে বি. এ পড়তো।
সেখানেও দলবেঁধে গানের আসর বসতো মাঝে মাঝে।

আমাদের বাড়িতে কাকা সেই হারমোনিয়ামটা নিয়ে গানের আসর বসাতো,
বাবার হাতে থাকতো মৃদঙ্,
বাবা কাকা দুজনেই গান করত্‌,
মা আর ঠাকুমাও গলা মেলাতো কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

জ্যাঠু এমনিতে গান করতো না,
তবে পান করার পর, তার গান গোটা পাড়ার লোক শুনতে পেত্‌,
গানের সাথে জ্যাঠুর নাচ দেখতে ছুটে আসতো সকলে।

আমার জন্মের পর দু দুবার আমাদের ভাড়া ঘর পুড়ে যায়।
বাবা মায়ের বিয়ের পাঁচ বছর পর আমার জন্ম,
তার জন্য মাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।
ভাগ্যিস ! আমি মেয়ে হয়ে জন্মাইনি
তাহলে হয়তো কন্যা সন্তানের ওপর পরিবারের সব রাগ গিয়ে পড়তো।

তবে আশ্চর্য হলেও সত্যি ! ঘরের সব জিনিসপত্র আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও
দুবারই হারমোনিয়ামটা বেঁচে যায় ।
একবার মামা, অন্যবার পাড়ার কিছু লোক
অনুষ্ঠানের জন্য নিয়ে গিয়েছিল।

মা বিকেলের দিকে নিরালায় কখনো কখনো হারমোনিয়ামটা নিয়ে গান করতে বসত ,
দুটো তিনটে গান-ই মুখে শুনতাম ।
আমার পরান যাহা চায়…
তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়।
এবং অবশ্যই
বলো বলো রে বলো সবে, বলো রে বাঙালির জয়।

মা কখনো কোথাও গান শেখেনি,
গানের অনুষ্ঠানে গান করেনি
নিজের মনে মনে নিজেকেই হয়তো গান শোনাতো
আমরা তিন ভাইবোন শুনতাম।

আবার আমাদেরও বাবা কখনো গান শেখানোর চেষ্টা করেনি
পড়াশুনার ওপরে জোর দিয়েছে বেশি।

জীবনের শেষ কুড়িটা বছর মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লো,
একলা ঘরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাঝে মাঝে ছড়া বলতো।
পাঁচালী পাঠ করে যেত,
এই একটি গান, ঘুরে ফিরে গাইতো।
বলো বলো রে বলো সবে, বলো রে বাঙালির জয়।
বাংলাদেশের নদীর বুকে এই বলি গান গাহিয়া যায়।

গাইতে গাইতে মা হাউহাউ করে কাঁদতো
মায়ের সুর ঠিক থাকতো না, কণ্ঠ ভেঙে ভেঙে যেত
কথা এলোমেলো হয়ে আসতো
কিন্তু আবেগ !

আমি জানিনা, এই গানের মধ্যে কি মিশে থাকতো
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি!
এই গানের মধ্যে কি মিশে থাকতো, স্বদেশ স্বজন হারানোর যন্ত্রনা!
নাকি নিতান্তই মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষের প্রলাপ

জীবনে অনেক যন্ত্রনা মাকে একটু একটু করে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে
ধীরে ধীরে ভারসাম্যহীনতার পথে নিয়ে গিয়েছে

তবে মা আর মাটির টান কখনোই প্রলাপ হতে পারে না ।

যে মাতৃভূমি আমার মাকে জন্ম দিয়েছে
যে জন্মভূমিকে আমার মা জন্মাতে দেখেছে ।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ