Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কন্যাশিশু

জন্মের পর থেকে হাসি হাসতে শেখেনি। দিনভর বিরতিহীনভাবে কেঁদেছে। পরিবারের পঞ্চম অনাকাঙ্ক্ষিত কন্যাসন্তান ও। ওর জন্মের খবরে একটুও হাসেনি স্বয়ং ওর বাবা, দাদা-দাদি, চাচা-চাচিরা। অনেকদিন ধরে একটি পুত্রসন্তানের জন্য পথ চেয়ে থাকা স্বজনদের মনে নিদারুণ হতাশা নিয়ে জন্মেছে সে। বংশের একমাত্র কর্ণধারের জন্য এতো অপেক্ষা যেখানে, সেখানে পঞ্চমবারের মতো হাসির আগমন সবার মুখের হাসি কেড়ে নিল। হাসির নানী মুখে হাসিখুশির অভিনয় করলেও হাসির গর্ভধারিণী মাও হাসির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। মনে মনে বলে ওঠেন, " হায়! আল্লাহ এবারও মেয়ে হলো। এই পোড়ামুখ ওকে আমি কীভাবে দেখাব!"

এরপর হাসিকে কোলে নিয়ে হাউমাউ করে চিৎকার করে আবার বলেন,

– কেনো ছেলে হলি না? চেহারা সুরতে এতো সুন্দর না হয়ে কুচকুচে কালো হতি। তাতে কোনো আফসোস থাকতো না।

বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দু'চোখের জল ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে মর্জিনা আক্তার আবার বলে ওঠেন,

– যে সমাজে লিঙ্গবৈষম্য আছে, সেই সমাজে চারটার পর পঞ্চম সন্তানও কন্যা হওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?

 

হাসির নানী মেয়ের শরীরে আলতো করে হাত রেখে কাঁদো গলায় বললেন,

– না, মা, ও কথা মুখে নিস না। এতে আল্লাহ অখুশি হবেন। সন্তান কন্যা হোক আর পুত্র হোক মায়ের কাছে আল্লাহর দেয়া এক অনন্য নেয়ামত। দেখিস না, কতো বাবা-মা নিঃসন্তান আছেন। একটিমাত্র সন্তানের জন্য তারা হাহাকার করে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ আল্লাহ-পাক তোকে পাঁচ পাঁচটি সুস্থ স্বাভাবিক কন্যাসন্তান দান করেছেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর।

 

মায়ের কথায় কিছুটা নির্ভার হয়ে মর্জিনা আক্তার বললেন,

– মা, তোমার কথাই ঠিক।  কিন্তু তোমাদের জামাইকে তো চেনোই। অন্য আট-দশজনের মতো ও না। এবার বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে ও আমার খুব কেয়ারিং করেছে। বারবার আমাকে বলতো, "এবার নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের মনোবাসনা পূরণ করবেন।" এখন ওর সামনে কীভাবে মুখ দেখাব, মা?

– তুই অধৈর্য হোস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস, আমার নাতনিকে দেখলে ও খুশি হয়ে যাবে।

– তাই যেনো হয়, মা।

মেয়ের জন্মের খবরে বরাবর সাতদিন বাড়ি ফিরেনি মতিউর। এ বাড়ি ও বাড়ি করতে করতে আত্মীয়স্বজন সবার বাড়িতে যোগাযোগ করা হলো। কিন্তু মতিউরের কোনো হদিস নেই। থানাপুলিশও করা হয়নি। মর্জিনা আক্তার স্বামীর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে থানায় ডায়রি করতে চাইলেও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তা করতে বারণ করায় তা আর করা হয়নি।

 

সবাই যখন মতিউরের উধাও হওয়া নিয়ে রীতিমতো দুশ্চিন্তার মধ্যে তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে ফিরে আসে। তবে স্বাভাবিক হয়ে  নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত রূপে। ডানহাতে ফুলের তোড়া আর বামহাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে সে। স্ত্রীর পাশে সন্তান, বাবা-মা, শ্বশুরশ্বাশুড়ি সবাইকে দেখে দ্রুত নবজাতক সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে চুমো খেয়ে দোলাতে দোলাতে বললেন,

– আম্মু, আমার আম্মু! ওলে — ওলে — আমার লক্ষ্মীসোনা মামণি!

বাবার কোলে উঠার পরপরই হাসি "ওয়াও! ওয়াও!" বলে কেঁদে ওঠে। কান্নায় বারবার ওর চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসে। মেয়েকে অবিরাম কাঁদতে দেখে মতিউর  বলে ওঠলো,
– মা আমার, তোকে দেখতে আসিনি বলে বাবার সাথে রাগ করেছিস? এই তোকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন তোকে ছেড়ে কোথাও যাব না।

এরইমধ্যে নুরা, সোমা, জুলি ও মিনু বাবাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ছেড়ে কেঁদে ওঠে। মতিউর সবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
– না রে মা, তোদের আমি ভুল বুঝেছিলাম।  আজ আমি আমার সকল ভুল বুঝতে পেরেছি।  তোরাই আমার পৃথিবী। বেঁচে থাকার আশা।

মর্জিনা আক্তার উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– কী হয়েছিল তোমার? গত সাতদিন তুমি কোথায় ছিলে?

মেয়েকে শ্বাশুড়ির কোলে তুলে দিয়ে মতিউর খাটের ওপর বসল। ছেলেকে কাছে পেয়ে মতিউরের মা বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠলেন। মাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ নীরবে অশ্রু ছেড়ে দিয়ে মতিউর বলল,

– যেদিন আমার ছোট্ট মামণি দুনিয়ায় এসেছিল সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে এগুচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার কন্যাসন্তান হবার খবর পেলাম। মুহূর্তে আমার মাথা ঘোরে যায়। আমি যেনো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত খবরে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেলাম। আর বাড়ির দিকে পা চলছিল না। কোনোভাবে যেন মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। চার চারটি কন্যাশিশুর পর আবার মেয়ে! একসময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি ঐ পোড়ামুখী মেয়েকে দেখব না। এই ভেবে উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে থাকি। যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে আসে। একসময় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। পরদিন এক গহীন জঙ্গলে ছোট্ট একটি ঘরের মেঝেতে নিজে আবিষ্কার করি। আমার স্বাভাবিক হতে প্রায় ছয়দিন কেটে গেল। এ কয়দিনে যে আমার খুব সেবাশুশ্রূষা করেছে সে আমার সমবয়সী একটি মেয়ে মানুষ। সুমী আক্তার। পাশের একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করে। আমার পাশেই একজন বয়স্কলোক শুয়ে শুয়ে কাশছিলেন। উনি গিয়াস উদ্দিন। সুমীর বাবা। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সুমীর সামান্য আয়েই তাদের সংসার খরচ চলে।

 

গতকাল জ্ঞান ফিরে পেয়ে সেই মেয়েটির সাথে আমার দুঃখের ঘটনা শেয়ার করি। সে গভীর মনোযোগী হয়ে আমার কথা শোনে। পাশ থেকে সুমীর বাবা হঠাৎ উঠে বসে আমাকে বললেন,
– এই বাবা, তুমি আমার কথা শোন।

আমি তার কাছাকাছি গিয়ে বসলাম। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দু'চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বললেন,

– এতক্ষণ ধরে তোমার কথাগুলো আমিও শুনছিলাম, বাবা। পঞ্চম কন্যাসন্তান হয়েছে বলে তুমি সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছেড়েছো। এটা নেহায়েত বোকামিই করেছো। আমি যদি তোমার মতো অমন পাঁচটি কন্যাসন্তানের পিতা হতাম!

আমি কিছুটা বিরক্তির ভঙ্গিতে বললাম,

– আঙ্কেল, আপনি কী আমাকে উপহাস করছেন?

– উপহাস করব কেনো, বাবা? আমি তোমাকে গর্বের সঙ্গে বলছি।

– পাঁচ পাঁচটা কন্যাসন্তান হলে আবার গর্ব কীসের! বংশের একমাত্র প্রদীপ যেখানে থাকছে না, সেখানে আবার গর্ব!

গিয়াস উদ্দিন সাহেব  অনেকটা রেগে গিয়ে বললেন,

– তোমার বয়স কতো, বাবা?

– আনুমানিক বিয়াল্লিশ।

– ওহ্! এইজন্যই। এখনো জীবনের কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি হওনি তো, তাই!

– আমি আপনার কথার কিছুই বুঝলাম না।

 

– তাহলে আমার গল্পটা শোন। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ছাত্রজীবনে খুব মেধাবী ছিলাম। পাস করে বের হয়েই ভালো চাকরি পেলাম। বলা যায় উপযুক্ত সময়েই বিয়ে করেছি। আমার পরপর চারটা পুত্রসন্তান হলো। এতে আমি খুবই খুশি ছিলাম। আমাকে দেখলে আত্মীয়স্বজনরা "সুখী মানুষ" বলে ডাকতো। আমিও তাদের কথায় সুখবোধ করতাম। এরপর পঞ্চম সন্তান হিসেবে জন্মেছে আমার এই সোনামা। ওর জন্মের পর আমি তেমন খুশি হইনি। অনেকটা স্বার্থপরের মতো। কিন্তু আমার ফ্যামিলির সবাই খুব খুশি হয়েছিল।  ওর নামটা আমার মা-ই রেখেছেন। আজ এতো বছর পর আমার মনে হচ্ছে, আমার মা-ই ঠিক ছিলেন। সত্যি মেয়ে আমার মায়ের মতোই হয়েছে। আর ছেলেরা আমায় পর করে দিয়ে সবাই নিজ নিজ অঙ্গনে সফল হয়েছে। আমার চরম দূরাবস্থায় একটুও কাছে আসেনি। খোঁজখবরও নেয়নি। একসময় আমাকে ওদের খুব প্রয়োজন হতো। তখন আমি ওদের সব আবদার পূরণ করে ধন্য হতাম। আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ওদের সব চাওয়া পূরণ করতে গিয়ে আমার সোনামাকে কখনও কখনও অবহেলা করেছি। অথচ যেদিন মাথাগোঁজার ঠাঁই হারিয়ে পথে নেমেছিলাম সেদিন সোনামাই আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা হয়েছিল। আজও আমি বেঁচে আছি ওর জন্যই। জানো বাবা, ওকে কতো করে বলেছি, বয়স হয়েছে। এবার বিয়েসাদী কর। কিন্তু ওর সেই একই কথা- "আমি চলে গেলে তোমায় কে দেখবে, বাবা?"

 

আমি বিস্মিত হয়ে উনার জীবনের গল্প শুনছিলাম আর চমকিত হচ্ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম উনার চোখদুটো রক্তজবার মতো লাল হয়ে গেছে। চোখ থেকে অঝরে পানি পড়ছে। সোনামাও ওর বাবার মতো করে কাঁদছে। আমি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে কান্না থামালাম। এরপর একে একে উনার সব ছেলের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানলাম। এক মুহূর্তে আমার ভাবনার জগত পাল্টে গেল। আমি ভাবতে শুরু করলাম- আহা! তাহলে তো আমি চরম ভুল পথে এগুচ্ছি। বাড়িতে আমার পাঁচ পাঁচটা জান্নাত রেখে এসেছি।

 

আমাকে বিচলিত হয়ে ভাবতে দেখে তিনি আবার বললেন,

– আবার কী ভাবছো, বাবা?

– না মানে ইয়ে। আঙ্কেল, আমার বাড়ির কথা ভাবছি। আপনার কথাগুলো আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি এখনই বাড়ি যেতে চাই।

 

গিয়াস উদ্দিন সাহেব চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন,

– যাও বাবা, আর দেরি না করে নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাও। এতোদিনে নিশ্চয় তোমার জন্য সবাই অস্থির হয়ে আছেন।

পাশ থেকে সোনামা বলল,

– না, বাবা, আগে খেয়ে নেবে। তারপর যাবে।

গিয়াস উদ্দিন সাহেব সন্তুষ্টির গলায় বললেন,

– হ্যাঁ, মা, তা-ই হবে।

 

আমার দিকে তাকিয়ে তিনি আবার বললেন,

– আমার মেয়ে যা বলে তা করেই ছাড়ে। বলছিলাম না, ও আমার মায়ের মতো হয়েছে। মায়ের উপরে কী কখনও কথা বলা যায়!

কথা বলার এক ফাঁকে আমাদের সামনে খাবারও চলে আসে। আমি আর গিয়াস উদ্দিন সাহেব মজা করে খাবার খেলাম। এরপরই আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই।
এ কথা বলে মতিউর আবার তার নবজাতক সন্তানকে কোলে তুলে আদর করতে থাকে। বাবার কোলে উঠার সাথে সাথে হাসি হেসে ওঠে। বাবা-মেয়ের এমন মধুর হাসি দেখে উপস্থিত সবাই হেসে ওঠলো। 

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ