অসমাপ্ত

ডাগর ডাগর চোখগুলো হঠাৎই থমকে গেল। আর কোন পলক পড়ছে না। এটা কি বললো জাওয়াদের মামা তাকে? ফোনটা কানের কাছেই এখনো রেখে দিয়েছে সে। মনে হচ্ছে, তার মামা এখুনি তাকে বলবে,"আরে ব্যাটা তুমি ভুল শুনেছো। এমন কিছুই হয় নি।"
কিন্তু না। জাওয়াদ আরেকবার তার মামাকে জিজ্ঞেস করলো,"ভাইয়ার কি হয়েছে বললে? নেটওয়ার্ক প্রবলেম করছে" ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,"বাবারে, তোর ভাইয়া মারা গেছে রে বাজান, তুই জলদি চলে আয় রে বাবা।" ফোনটা কেটে গেল। চোখের সামনে থাকা খাবারের টেবিলে স্যুপ থেকে ধোঁয়া ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে দুচার মিনিট আগেই। কানে কোন শব্দ ঢুকছে না জাওয়াদের। সবকিছুই ঘোলা লাগছে, সে বুঝতে পারে তার চোখের অগ্রভাগ পুরোটা পানিতে ভরে গেছে, সেখানে আর জায়গা নেই। তবুও চোখে পানি আসা থামছে না। তারমানে এখুনি সে কান্না করবে। এ
সব ভাবতে থাকে জাওয়াদ। মামার কথাটা মাথায় এখনো গেঁথে ওঠে নি তার। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে ফেলে। শেষ কবে কেঁদেছিল সে? একটু মনে করার চেষ্টা করল জাওয়াদ। না– মনে পড়ছে না। আরেকটু জোর দিলে বুঝতে পারে যে সময় থেকে বুঝতে শিখেছে, তখন থেকে আজ অব্ধি সে কাঁদেনি। প্রচণ্ড শক্ত এবং জেদি মানুষিকতার ছেলেটি আজ ভাইয়ার স্মৃতিতে কেঁদে ফেলল। সে নাকি মৃত! কি সব বলছে তার মামা! মামা হয়তো পাগল হয়ে গেছে, তাই এসব উলটা পালটা বকছে, বাসায় গিয়ে মায়ের কাছে দেবে নালিশ।
এসব ভাবতে ভাবতে দেখে একজন ওয়েটার এসে তাকে জিজ্ঞেস করল,"স্যার, কোন সমস্যা?" "না, আর বিলটা নিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি।" "অকে স্যার" ওয়েটারটির কথায় বিনম্রতার ছাপ। তার জীবনেও কি জাওয়াদের মত কিছু ঘটেছে? সেও কি তার কাছের কাউকে কখনো হারিয়েছে? হারালে কি এত ঠাণ্ডাভাবে সে সব কাজ করতে পারত? এই প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরছে ঠিক এমন সময়ে বিল নিয়ে সে হাজির। বিলটা দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো জাওয়াদ বাসার উদ্দেশ্যে।
রিকশাওয়ালা লোকটা এখন ভাড়া নিয়ে ত্যাড়ামি করতেছে। জাওয়াদ মনে মনে বিরক্ত, একটু রাগ করে বলে উঠলো,"তোমরা তো পারলে আমাদের বেচে খাও!" এই বলে ওঠে পরল। আশেপাশের, রাস্তার কোন কিছুই তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না। ঠিক তখন একটা মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে মাদ্রাসার কিছু ছেলে এসে তাদের মসজিদের কাজ করানোর জন্য কিছু দান চেয়ে বসে। জাওয়াদ পকেটে হাত দিতে দিতে দেখে রিকশাওয়ালা পকেট থেকে ৫০ টাকার একটা নোট ছেলেটার হাতে দিয়ে দিলো, অথচ সে দান করার জন্য বের করেছিল ১০ টাকা। হালকা লজ্জা লাগে তার। পরে আরো কিছু নোট একত্র করে দিয়ে এগুতে থাকে।
মনে মনে ভাবছে লোকটাকে সে ছোটলোক ভেবেছিল, কিন্তু তার মন তো বিশাল। হয়তো কোন কারণে টাকার দরকার তাই একটু বেশিই ভাড়া চেয়ে ফেলেছে। আর সে তো জানে না আমার পরিস্থিতি। তার সাথে রাগ করার কোন মানেই ছিল না। এমনটাও হতে পারে তার পরিবারে আমার থেকে বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এমন সময় মামা আবার কল দিলো,"বাবা কই গো তুমি?" "মামা আমি রাস্তায় মামা, আসতেছি। কেমনে কি একটু খুলে বলো।" "তোদের এদিকে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে না? পানি জমে গেছে না কিছু যায়গায়?" " হুম" "সেই পানিতে কারেন্টের লিকড তার ছিল" "তুই তো জানিসই এখানে সমস্যা হলে ঠিক হতে কতক্ষণ লেগে যায়! কোনটা কিসের তার সেটা খুঁজে বের করতে করতেই ৩/৪ ঘণ্টা লেগে যায়। তোর ভাইয়া কলেজে লেকচার দিয়ে তার নাইম নামের এক স্টুডেন্টের সাথে কথা বলতে বলতে ফিরছিল, তখন অই পানির কারেন্টে শক খেয়ে তারা দুজনেই।" "মামা কেঁদো না মামা, তুমি কাঁদলে আমি নিজেকে শক্ত রাখতে পারবো না। তুমি মা কে সামলাও আমি আসতেছি।"
রিকশা থামলে রিকশাওয়ালাকে টাকা দিলে সে জাওয়াদকে বলে,"কিছু মনে কইরো না বাবা, আসলে বেশি ভাড়া এমনেতে চাই না। আমি আসলে বাড়ি ফিরবার চাইছিলাম, তুমি তো যাবা পুরা উলটা দিকে। তাই ভাবলাম একটু বেশি চাইয়া দেখি যদি দাও। এত আগে অবশ্য আমি বাড়ি ফিরি না, কিন্তু আজ মন সায় দিতাছে না কামে। মনে হইতাছে কিছু একটা সমস্যা হইছে বা হবো।
"এরকম কেন মনে হচ্ছে চাচা?" "জানি না গো বাবা, কিন্তু আজ কলেজে যাওয়ার আগে পোলায় আমারে ওর বৃত্তির টাকা হাতে দিয়া, সালাম করল। আর কইলো, দোয়া কইরো আব্বা। আমার পোলাডা খুব ভালা ছাত্র।"" বাহ, কোন কলেজে পড়ে?" "মইনুদ্দীন কলেজ গো বাবা"। জাওয়াদের কপাল কুচকে গেল, চোখে এক ধরনের আতঙ্ক! " নাম কি গো চাচা?" "নাইম হোসেন, ওর রোল নাকি ২ হইছে এবার।"