জেনে নিন ডিমের খোসার পুষ্টিগুণ ও ব্যবহার
আমিষ–জাতীয় খাদ্যের প্রধান উৎসগুলোর একটি হচ্ছে ডিম। শরীরের জন্য অনেক উপাদেয় খাবার হলো ডিম। একজন সাধারণ মানুষের প্রতিদিনই একটি করে ডিম খাওয়া উচিত। সকালের নাস্তার জন্য উত্তম ও সাধারণ খাবার হলো ডিম।
ডিম খাওয়ার ব্যাপারে জাপানিরা সবচেয়ে এগিয়ে আছে। তারা প্রত্যেকে গড়ে প্রতিবছর ৩২০টি ডিম খেয়ে থাকে। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশে এই সংখ্যা সে তুলনায় অনেক কম, প্রায় ১০৩টি। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে অন্য যেকোনো প্রাণীজ আমিষের চেয়ে ডিমের আধিপত্য বেশি । দামে কম, বেশি পুষ্টিকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মহামারির সময়ে প্রোটিন বুস্ট আপের প্রধান উপায়ই হচ্ছে ডিম খাওয়া।
এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই এত এত ডিমের কত খোসা আমরা ফেলে দিচ্ছি প্রতিদিন! অথচ ডিমের খোসার রয়েছে বৈচিত্র্যময় উপযোগিতা আর বহুমুখী ব্যবহার। ডিম খাবার আগে ডিমের খোসা সাধারণত ফেলেই দেয়া হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা ডিমের খোসার রয়েছে বৈচিত্র্যময় উপযোগিতা আর বহুমুখী গুণ। ডিমের খোসা দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা যায়।
ডিমের খোসা ক্যালসিয়ামের এক অফুরন্ত খনি
আমাদের দেশে ছোট–বড় সবার প্রায়ই ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি হয়। বিশেষত গিঁটেবাত, হাড়ের ক্ষয়, হাড় ফাঁপা হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন ব্যথা–বেদনা, ভঙ্গুর দাঁত ও নখ ইত্যাদি রোগে দেশের শিশু ও বয়স্ক জনগণের একটি বিরাট অংশ ভুগে থাকে। অথচ অত্যন্ত কম খরচে ডিমের খোসা থেকে তৈরি ক্যালসিয়াম পাউডার আমাদের দৈনিক ক্যালসিয়ামের চাহিদা সম্পূর্ণভাবে মেটাতে পারে।
সঠিকভাবে প্রস্তুতকৃত এক চা–চামচ ডিমের খোসার চূর্ণতে আছে ৮০০-১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম।অথচ ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস হিসেবে জনপ্রিয় দুধে এই উপাদান থাকে প্রতি এক কাপে মাত্র ৩০০-৪০০ মিলিগ্রাম। আর একজন সুস্থ–স্বাভাবিক মানুষের দিনে ৫০০ থেকে ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। গর্ভবতী ও স্তন্য-দানকারী মায়ের জন্য এই প্রয়োজনের পরিমাণ আরও বেশি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ডিমের খোসায় ক্যালসিয়াম মূলত ক্যালসিয়াম কার্বনেট হিসেবে থাকে, যা কিনা আমাদের হাড় ও দাঁতের মূল উপাদানের সঙ্গে একেবারে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই তা সহজে ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই শরীরে শোষিত হয়ে আমাদের উপকার করতে পারে।
সারা বিশ্বে হাড়ের ব্যথা, ক্ষয়, জোড়ের বিকৃতিতে কষ্ট পাচ্ছেন যারা, এমনকি হাড়ের কার্টিলেজ শুকিয়ে যেতে থাকা রোগীরাও ডিমের খোসার চূর্ণ সেবন করে সুস্থ জীবন যাপন করছেন। এ ছাড়া পেশির সংকোচন-প্রসারণ, স্নায়ুতন্ত্র ভালো রাখা ও শরীরের কোষ গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে ক্যালসিয়ামের বিকল্প নেই। তবে অন্য যেকোনো ক্যালসিয়াম বড়ির মতোই অনেকের ডিমের খোসার চূর্ণ বেশি সেবন করলে হজমে কিছু সমস্যা বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সহনশীলতা অনুযায়ী খাওয়া উচিত এই পাউডার।
ডিমের খোসার চূর্ণ এর প্রস্তুত প্রণালি
প্রথমেই ভালো, রোগমুক্ত, অর্গানিক, তাজা ডিমের খোসা নিয়ে তার পর্দা, আঠাসহ আলগা ময়লা ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, যেন ডিমের খোসা খুব পাতলা না হয়। এবার জীবাণুমুক্ত করার জন্য ফুটন্ত পানিতে খোসাগুলো ভালোভাবে ১০ মিনিট ফুটিয়ে নিতে হবে। খোসাগুলো তুলে, পানি ঝরিয়ে ও শুকিয়ে নিয়ে বেকিং শিটে করে ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ১০ মিনিট বেক করে নিতে হবে, যেন সম্পূর্ণ জলীয় অংশ চলে যায়।
এবার ডিমের খোসাগুলো কফি গ্রাইন্ডার বা চিনি গুঁড়া করার ব্লেন্ডারে মিহি গুঁড়া করে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে ডিমের খোসা-চূর্ণ। একটি শুকনা বয়ামে ভরে রাখলে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন এক চামচ পাউডার পছন্দমতো স্যুপ, তরল পানীয়, শরবত, স্মুদি ইত্যাদির সঙ্গে গুলে খাওয়া যায়। বিভিন্ন হেলথ ফুড স্টোরে এগ শেল ক্যালসিয়াম পাউডার কিনতেও পাওয়া যায়।
পশু ও পাখির খাদ্যে ডিমের খোসা
শুধু মানুষের নয়, পশু ও পাখির খাদ্যকেও ক্যালসিয়ামের পরিপূর্ণতা দিতে পারে ডিমের খোসার চূর্ণ। এ ছাড়া হাঁস–মুরগি নিজে নিজেই ঠুকরে ডিমের খোসা খেতে পছন্দ করে। বাড়ির বিড়াল, কুকুর, খরগোশ বা পোষা পাখির জন্য ডিমের খোসার চূর্ণ দিয়ে মিনারেল ব্লক বানিয়ে দেওয়া যায়। গবাদিপশুর খাবারেও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি মেটাতে পারে ডিমের খোসা।
বাগানে ডিমের খোসা ব্যবহার
বহু যুগ ধরেই বিশ্বের সব দেশে গাছের নাইট্রেট সারের সহায়ক হিসেবে প্রোটিনের চাহিদা মিটিয়ে আসছে ডিমের খোসা। অকালে কুঁড়ি, ফুল, ফল ঝরে পড়া রোগে ও অপুষ্টির জন্য বাগানে গাছের গোঁড়ায় ডিমের খোসা দেন সবাই। ডিমের খোসা টুকরা করে ছড়িয়ে রাখলে পাতা খেয়ে ফেলা ল্যাদা পোকা, স্লাগ, শামুকের হাত থেকে গাছ রক্ষা পায়। বারান্দা বাগানের টবে গাছের গোঁড়ায় ডিমের খোসা দিতে পারেন।
এ ছাড়া ইদানীং ডিমের খোসায় করে এক অভিনব বীজতলার প্রচলন হয়েছে সারা বিশ্বে। ডিমের বাক্সেই ডিমের খোলায় সার মেশানো অল্প ভেজা মাটি দিয়ে বীজ বপন করা হয় এই ব্যবস্থায়। এ ক্ষেত্রে গজিয়ে ওঠা চারা, ডিমের খোসাসহই রোপণ করে দেওয়া যায়। এতে স্থানান্তরের সময়ে নতুন চারার কোনোরূপ ক্ষতি হয় না, বরং ডিমের খোসার পুষ্টি বাড়তি পাওনা হিসেবে থাকে।
সারা বিশ্বে প্রতিদিন যে বিশাল সংখ্যক ডিম আমরা খাই, তার খোসাগুলো ফেলে না দিয়ে এসব বিকল্প ব্যবহার করতে পারলে তা আমাদের জন্য খুবই উপকারে আসবে। বিকল্প খাদ্য উৎস, পুনর্চক্রায়ন বা রিসাইক্লিং, ময়লা–আবর্জনার স্তূপ ও পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনা, যে আঙ্গিক থেকেই দেখি না কেন, সময় এসেছে ডিমের খোসা ময়লার ভাগাড়ে ফেলার আগে একবার ভেবে দেখার। তাই এই বহু উপাদেয় ডিমের খোসা ফেলে না দিয়ে কাজে লাগান।