করোনাকালে নেতৃত্বহীন আমেরিকা
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে সর্বদা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চান এটা নতুন করে ধর্তব্যের বিষয় নয়; কিন্তু আমেরিকার ঘরের ভেতর করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নতুন করে নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করছেন তা আগে কখনো দেখা যায়নি। তারমধ্যে এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
এই এমপ্যাথি বা সহমর্মিতার অর্থ কী? ইংরেজি ডিকশনারিতে এমপ্যাথি শব্দটির অর্থ লেখা আছে একজন ব্যক্তির অন্যের অনুভূতি বোঝা এবং তার সে সমস্যার সঙ্গে নিজেকেও সমানভাবে অংশীদারি করা।
অর্থাত্ আমরা বলতে পারি অন্যের বোঝা খানিকটা নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া; কিন্তু গত দুই মাসে হাজার হাজার আমেরিকান মারা গেছে এবং এখনো যাচ্ছে, লাখ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালগুলো নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি এবং মেশিনপত্রের অভাবে ভুগছে।
এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণ আমাদের কাছে করোনা ভাইরাসের চেয়েও নিষ্ঠুর বলে মনে হচ্ছে। কতটা অসমর্থ এই প্রেসিডেন্ট যে তিনি সহমর্মিতা নয়, বরং করুণা প্রদর্শন করতে চেষ্টা করছেন। মানুষের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হয়ে, এমনকি তার দেশের লাখ লাখ মানুষের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতির অংশীদার হওয়ার ভান না করে তিনি তার প্রশাসনের কোভিড-১৯-এর ব্যর্থতা ঢাকতে নানা মিথ্যা বলছেন এবং নানা কাহিনি তৈরি করে আজেবাজে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
প্রথমে তারা বলেছিলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। যখন আপাতদৃষ্টিতে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ছিল তখন বলেছিলেন গরম এলেই এই ভাইরাসের সমস্যা চলে যাবে, অলৌকিকভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এরপর তিনি চীনকে দোষারোপ করলেন এবং ভাবলেন চীন ভ্রমণ সীমিত করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
ট্রাম্প এমনকি মিডিয়াকে ভুল বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, তার সরকার করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেননি ডেমোক্র্যাটদের অভিশংসন প্রচেষ্টার কারণে।
এই সপ্তাহেই ট্রাম্প যখন অব্যাহতভাবে তার শত্রুদের আক্রমণ করে যাচ্ছেন এবং তার ভিত্তি মজবুত করতে চাচ্ছেন, তখন একজন রিপোর্টার ট্রাম্পের সময়ক্ষেপণ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, যার ব্যাখ্যা ট্রাম্পের কাছে নেই।
পলা রিড নামে আমেরিকান নিউজ নেটওয়ার্ক সিবিএসের একজন রিপোর্টার ট্রাম্পকে চাপ দিয়ে জানতে চাইলেন, তার প্রশাসন চীনের সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত করার পর কেন আসন্ন করোনা ভাইরাস বিষয়ে ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রস্তুতি গ্রহণ করল না?
ট্রাম্প তার কথার মধ্যখানে বিঘ্ন ঘটিয়ে তাকে ‘মর্যাদাহানিকর’ বলে উল্লেখ করার আগেই রিড তার প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা হসপিটালগুলো প্রস্তুত করেননি, দ্রুত টেস্টের ব্যবস্থা করেননি।’
ট্রাম্প যখন তাকে বাধা দিয়ে কথা বলছিলেন তখনো রিড তার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘এই ফেব্রুয়ারি মাস হাতে পেয়েও আপনারা কী করেছেন?’ তিনি যখন বলছিলেন পুরো ফেব্রুয়ারি মাস তখন অসন্তোষের সঙ্গে রিডের দিকে তাকিয়ে ট্রাম্প বললেন, ‘অনেক অনেক।’ কিন্তু তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কী করেছেন তা বলতে পারলেন না; কিন্তু অবশেষে রিডের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি জানো, তুমি একজন ভুয়া।’
এই রিপোর্টার তার প্রশ্নের উত্তর পাননি; কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী লোকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাহসের সঙ্গে তাকে মোকাবিলা করার জন্য প্রশংসনীয় হতে পারেন। এই রিপোর্টার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে জানতে চেয়েছেন, ইতালিকে ছাপিয়ে বিশ্বে সর্বাধিক করোনা ভাইরাসে মৃত্যু ঘটেছে আমেরিকায়, এ সম্পর্কে ট্রাম্প কী বলবেন। আমেরিকার প্রতিটি মানুষ এবং বিশ্ব দেখেছে, ট্রাম্পের কাছে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
সত্যি কথা কি, আমার আমেরিকার জন্য খারাপ লেগেছে, দুঃখ বোধ হয়েছে। দেশটির এই ভীষণ দুর্গতির সময় আমেরিকার আরো ভালো করা উচিত ছিল। আমার মনে হয় আরো ভালো একজন নেতা আসতে পারতেন যিনি দেশটির জন্য আরো ভালো কিছু করতে পারতেন।
এই অন্ধকার সময় থেকে টেনে তুলতে পারতেন। অধিকাংশ আমেরিকানই এমনটি কখনো দেখেনি এবং এ ধরনের দুর্গতিতে তারা অভ্যস্ত নন। ফলে এই ধাক্কা আমেরিকার জন্য খুব বড়ো ধাক্কা।
বিশেষ করে একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমি চিন্তা করি, এই আমেরিকা আমার জন্মভূমিকে কতবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি চাই আমেরিকার বর্তমান নেতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের কথা না ভেবে, নিজের কথা না বলে তার দেশের সাহায্যে এগিয়ে আসুক।
একজন বাংলাদেশি হিসেবে ট্রাম্পের নেতৃত্বের অন্তঃসারশূন্যতা দেখে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আপনি যাই বলুন, আমাদের নেতাদের জনগণের ওপর অন্তত একটা সহানুভূতি আছে।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি সাংবাদিক, নারী অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ