করোনা ভাইরাসের গল্প
কোভিড-১৯ ওরফে সার্স-কভ-২ নামক বৈশ্বিক মহামারি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যাকে ‘প্যান্ডেমিক’-এর মর্যাদায় ভূষিত করেছে, ইত্যবসরেই সে ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি করেছে। এই মুহূর্তে তার মাপজোক করা কঠিন, তবে পৃথিবী নামক যে গ্রহে আমরা বসবাস করছি, এই অতিকায় সংকট হয়তো-বা সেখানে বিরাট পরিবর্তন ঘটানোর বার্তা বহন করছে। গত কয়েক মাস ধরে আসলে পৃথিবীর বৈশ্বিক প্রশাসনব্যবস্থা চালাচ্ছে ‘কোভিড-১৯’। অর্থাৎ করোনা ভাইরাসকে নির্ভর করে কোভিড-১৯ ‘মেগাহিরো’রূপে আবির্ভূত হয়েছে। করোনা ভাইরাস আবার কী? উদাহরণস্বরূপ, যেমন : ঠান্ডা লেগে সর্দি-জ্বর হাঁচি-কাশি হওয়া থেকে শুরু করে (যাকে কমন কোল্ড বলা হয়) শ্বাসপ্রশ্বাস-সংশ্লিষ্ট লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন : ‘মার্স’ করোনা ভাইরাস (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম), ‘সার্স’ (সিভিয়ার রেসপিরেটরি সিনড্রোম) করোনা ভাইরাস—ইত্যাদির জন্য পৃথক যে ভাইরাসগুলো দায়ী তারা সবাই ‘করোনা’ নামক ভাইরাস পরিবারের সদস্য।
সাধারণভাবে বলা হয় যে, করোনা ভাইরাস প্রাণিজগতের বিভিন্ন শ্রেণির জন্তু-প্রাণীদের মধ্যে ‘বসবাস’ করে এবং কখনো-বা জন্তু প্রাণীদের থেকে মানুষ-প্রাণীতে স্থানান্তরিত হতে পারে। (একে ‘স্পিলওভার ইভেন্ট’ বলা হয়)। কিন্তু এই আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বিশ্বশাসক প্রাণী-টু-মানুষ প্রক্রিয়ায় ঘটেনি, হয়েছে ‘মানুষ-টু-মানুষ’ প্রক্রিয়ায়। তবে নিউ ইয়র্কের ‘ব্রংক্স’ শহরের চিড়িয়াখানায় এক বাঘ-দম্পতি ও এক সিংহ-দম্পতি ‘কোভিড-১৯’-এ আক্রান্ত হয়েছে বলা হচ্ছে। তাদের শুকনো কাশি হয়েছে। ভাইরাস ছাড়াও প্রকৃতিতে ব্যাকটেরিয়া নামে পরিচিত আরেকটি অস্তিত্ব রয়েছে। যদিও ব্যাকটেরিয়াজনিত ও ভাইরাসজনিত সংক্রমণ-উপসর্গের মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে, যেমন : জ্বর, গা ম্যাজম্যাজ করা, গলা খুসখুস করা, ব্যথা ইত্যাদি। কিন্তু দুইয়ের মধ্যে জীববিজ্ঞানগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। তাই ব্যাকটেরিয়াগত রোগের চিকিত্সা হয় ভিন্নভাবে। এই দুই অস্তিত্বের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো যে :ব্যাকটেরিয়া হলো অতি ক্ষুদ্র অস্তিত্ব, যার রয়েছে প্রাণ এবং সাধারণত এক কোষবিশিষ্ট, তার অস্তিত্ব সর্বব্যাপী। ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া সংক্রামক ব্যাধি ঘটাতে পারে, যেমন : যক্ষ্মা রোগ। আবার রয়েছে বন্ধু ব্যাকটেরিয়া, যেমন : দই, গাজন প্রক্রিয়ায় তৈরিকৃত পানীয় ইত্যাদি। অপরদিকে আকারের দিক দিয়ে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে ক্ষুদ্র এবং প্রাণহীন জড় অস্তিত্ব, পরজীবী বা প্যারাসাইট। জীবনযাত্রার জন্য ব্যাকটেরিয়ার মতো স্বাধীনতা তার নেই, টিকে থাকার তাগিদে তাকে আতিথ্যকর্তাকে না পেলেই নয়। তার সহজ আশ্রয়কর্তা হলো জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদির জীবকোষ, জীবকোষের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া মাত্রই ভাইরাসটি নিজের হুবহু প্রতিকৃতি উৎপাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে আরেকটি পার্থক্য হলো যে অধিকাংশ ভাইরাস মাত্রই রোগব্যাধি ঘটায়। ভাইরাসজনিত রোগের মধ্যে রয়েছে, যেমন : জলবসন্ত, এইচআইভি, হার্পিজ, সাধারণ ঠান্ডা লাগা। এই কোভিড-১৯ সংক্রমণটির বিশেষত্ব হলো যে, সে যখন কাউকে সংক্রমিত করে (‘শূন্য’ দিন—শূন্য পর্ব), পাঁচ দিন থেকে আট দিন পরে সংক্রমিত ব্যক্তিটি বুঝতে পারেন যে তিনি কোভিড-১৯-এর শিকার হয়েছেন। কিন্তু এই পাঁচ থেকে আট দিনের সময়সীমায় কোভিড-১৯ ধারণকারী এই আপাত ‘সুস্থ’ ব্যক্তিটি যদি সবার মধ্যে ঘুরে বেড়ান—যাদের সংস্পর্শে তিনি আসেন তো সম্ভাব্যরূপে তারা সংক্রমিত হতে পারেন। অর্থাত্ এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। আমরা বলতে পারি যে ভাইরাস সম্পৃক্ত শ্বাস-প্রশ্বাস সংশ্লিষ্ট ব্যাধির, যেমন : ‘সার্স’-এর সংক্রমণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোভিড-১৯-এর মিল রয়েছে, তফাত হলো যে—‘সার্স’ আক্রান্তের ক্ষেত্রে ভাইরাস আশ্রয় নেয় ফুসফুসের ভেতরে, কোভিড-১৯-এর ভাইরাস কণ্ঠনালি থেকে আরেক কণ্ঠনালিতে নতুন ঠাঁই নেয়। অর্থাৎ শেষোক্তটি কণ্ঠনালির উপরাংশে ঠাঁই গেঁড়ে বসে এবং জীবকোষের হুবহু নকল কর্ম শুরু করে, যার অর্থ হচ্ছে যে সে অধিকতর সংক্রামক, অপরদিকে প্রথমোক্তটি ফুসফুসের গভীর অভ্যন্তরে আস্তানা গাড়ে বলে ততটা সংক্রামক নয় বটে কিন্তু তুলনামূলকভাবে অধিকতর বিপজ্জনক।
আসলে ভাইরাস সংশ্লিষ্ট সংক্রামক ব্যাধিমাত্রই মাত্রাভেদে বিপজ্জনক ব্যাধি (‘কমন কোল্ড’ থেকে শুরু করে শীতকালীন ফ্লু, সার্স, মার্স, সোয়াইন ফ্লু’…বিশেষ করে যখন টিকা বা ভ্যাকসিন না থাকলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বইকি)। সংক্রমণের মাত্রা যা-ই হোক না কেন, অবশ্যমান্য শর্ত হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যেমন : সর্দি-কাশি গলা খুসখুস করা জ্বরসর্বস্ব ঠান্ডা লাগার (কমন কোল্ড) কথাই ধরা যাক। প্রাপ্তবয়স্করা বছরে গড়ে দুই থেকে চার বার এবং তরুণ বাচ্চারা বছরে ছয় থেকে আট বার এই ভাইরাস রোগে আক্রান্ত হয়, অথচ এর কোনো টিকা/ভ্যাকসিন নেই। এই রোগে আক্রান্ত সন্তানকে যদি স্কুলে পাঠান তো দেখবেন যে দুই-তিন দিনের মাথায় রোগী সন্তানের পুরো ক্লাসই অসুস্থ হয়ে গেছে। এই রোগের প্রতিষেধক হলো :সন্তানকে স্কুলে না পাঠানো এবং বাড়ির লোকদের জন্য অবশ্যমান্য ‘ওষুধ’ হলো : হাত ধোয়া, আধোয়া হাত দিয়ে চোখ-নাক-মুখ ইত্যাদি স্পর্শ না করা, রোগীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি। দেখছেন তো সার্স, কোভিড-১৯ ইত্যাদিতে সংক্রমিত না হওয়ার প্রতিষেধক হিসেবেও অনুরূপ সাবধানতা নিতে হয়। পৃথিবীতে অনেকবারই নানা ধরনের রোগের মহামারি হয়েছে, যেমন :কলেরা, বসন্ত (স্মল পক্স), ম্যালেরিয়া, ইবোলা, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া (প্রায় আনকোরা নতুন ব্যাধি)।
একবিংশ শতাব্দীতে, ২০০২/২০০৩ সালে চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সার্স ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, ২০০৯/২০১০ সালের সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদি। দুটোই ‘পান্ডেমিক’-এর মর্যাদাপ্রাপ্ত মহামারি ছিল। এ পর্যন্ত, এসব মহামারি পশ্চিমা জগত্ বাদে পৃথিবীর অন্যত্র কোথাও না কোথাও ভয়ংকর রূপ নিয়ে সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এবারে কোভিড-১৯ যথাক্রমে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এসে হাজির। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে, এই প্রথম ইউরোপ, এবং (ঊনবিংশ শতাব্দীর) সিভিল ওয়ারের পরে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জাতীয় সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। ফলে, শুরু হয় পাশ্চাত্য স্টাইলের বিশৃঙ্খল অবস্থা। করমর্দন/(বাড়িতে থাকলেও) হাত ধোয়াধুয়ি থেকে শুরু করে পৃথিবী নামক গ্রহকে ‘লকডাউন’ করা হয়। থেমে যায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের চাকা, এমনকি চিরায়ত সামাজিক/পারিবারিক সম্পর্ক তিরোহিত হয় এবং ‘যার যার তার তার, কেউ কারো নয়’ স্তরে চলে আসে। যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিয়মিতভাবে আমাদেরকে :‘অতজনের’ রোগসংক্রমণ হয়েছে, এবং ‘অতজন’ মারা গেছে-র সংবাদ দিচ্ছে কিন্তু তাদের সেই উপস্থাপনায় রোগনির্ণয়/ডায়াগনসিস ও রোগসংক্রমণের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হচ্ছে না।
পশ্চিমা জগতের জন্য ‘পাসপোর্ট’বিহীন (প্রেসিডেন্ট মাক্রনের ভাষায়) কোভিড-১৯-এর ছড়িয়ে পড়ার বাস্তবতা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। বাকি বিশ্বের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যে ‘সাংঘাতিক বিপজ্জনক’ রোগটিকে আয়ত্তে আনার কোনো প্রস্তুতি পশ্চিমের নেই। অথচ চীনসমেত এশিয়ার কয়েকটি দেশ নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে কোভিড-১৯কে মোকাবিলা করে ও করছে, সেসব কাহিনি কারো অজ্ঞাত নয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস, চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনা ভাইরাস তখনো যখন মহামারির আকার নেয়নি, তার প্রায় সপ্তাহ ছয়েক আগে ডাভসের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডাভস ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম) জন্স হপকিন্স সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটি, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, সিআইএ, মাইকেল ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথ ইত্যাদির সহযোগিতায় ১৮ অক্টোবর নিউ ইয়র্ক সিটিতে করোনা ভাইরাস মহামারিকে কেন্দ্র করে ‘হাইপোথেটিক্যাল’ রিহার্সেলের/মহড়ার আয়োজন করেছিল। এটির নাম ‘ইভেন্ট ২০১ গ্লোবাল পান্ডেমিক ইক্সারসাইজ’ (Event 201)।
এই মহড়ার লক্ষ্য ছিল বহুজাতিভিত্তিক করপোরেশনসমূহ এবং সরকারের প্রতিক্রিয়াসংক্রান্ত তথ্য আহরণ করা। মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ও চীনের ব্যাধি ও মহামারি নিয়ন্ত্রণ অফিসের দুই উচ্চপদস্থ কর্মচারীসহ ১৫ জন বিশ্বনেতা উপস্থিত ছিলেন। এই একই সন ও তারিখে উহানে ‘মিলিটারি ওয়ার্ল্ড গেমস’-এর উদ্বোধন হয় (১৮-২৭ অক্টোবর, ২০১৯), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ১৪০টি দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা অংশ নিয়েছিল। ‘ইভেন্ট ২০১’-এর মহড়ার স্বভাব প্রকৃতি চীন ও রাশিয়া তো বটেই উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি এশীয় দেশগুলো যথার্থ অনুধাবন করেছিল। এসব দেশ করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব রোধ করতে সম্পূর্ণরূপে হেরমেটিক ‘লকডাউন’ করেনি। কারণ, প্রথমত, মেডিক্যাল চিকিত্সাদি প্রদানের মতো প্রস্তুতি এসব দেশের রয়েছে এবং জোর দিয়েছে প্রথম কনট্যাক্টটিকে খুঁজে বেরকরণ, সুস্থদের কাছ থেকে অসুস্থকে পৃথককরণ ও আক্রান্তকে নজরে নজরে রাখা (ভিডিও ক্যামেরা সার্ভেলেন্স, ক্রেডিট কার্ড, স্মার্টফোন ইত্যাদির সাহায্যে) বিষয়গুলোর ওপরে। অপরদিকে পাশ্চাত্য জগত্ প্রধান ব্যবস্থা হিসেবে সম্পূর্ণ পৃথিবীকে স্থবির লকডাউনে নিয়ে আসে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’-এর স্থলে শুরু হয় ‘ভাইরাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ’-এর। তবে এই লকডাউনের চাপে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া অর্থব্যবস্থার অডিট কিন্তু বাকি আছে।
লেখক : নাদিরা মজুমদার
আন্তর্জাতিক ও বিজ্ঞান বিষয়ক বিশ্লেষক