প্রযুক্তি ক্ষমতায়নের হাতিয়ার
প্রযুক্তি আর নারীর ক্ষমতায়ন দুটোই আধুনিক বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয়। একসময় নারীদের ক্ষমতায়ন । শুধু শিক্ষার সীমাবদ্ধতায় ছিল, কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য অমূল্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নারীরা প্রযুক্তির হাত ধরে নতুন নতুন সুযোগের সন্ধান পাচ্ছেন। কর্মসংস্থান, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় প্রযুক্তি যে ভূমিকা রাখছে, তা শুধু নারীদের জীবনের মান উন্নত করছে না, বরং সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
প্রযুক্তির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচন
প্রযুক্তির অগ্রগতি আজ নারীদের ঘরে বসে আয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক ডিজাইন, এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েশনসহ নানা ডিজিটাল প্লাটফর্মে কাজের মাধ্যমে নারীরা তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করছেন। UNDP -এর এক জরিপ অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে অনলাইন কর্মসংস্থানে নারীদের অংশগ্রহণের হার গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ‘জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ এর প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নারীরা ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্সে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে প্রযুক্তির ভূমিকা
অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ডিজিটাল প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে একটি বড় ভূমিকা রাখছে। MOOC (Massive Open Online Courses) এবং বিভিন্ন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নারীরা এখন যেকোনো জায়গা থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছেন। এমনকি যারা পরিবার বা সামাজিক কারণে বাইরে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পান না, ভারাও ঘরে বসেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের মধ্যে STEM (Science, Technology, Engineering, and Mathematics) বিষয়ক কোর্সের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
নারীর স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অবদান
নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির অবদানও অনস্বীকার্য। টেলিমেডিসিন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, এবং অনলাইন স্বাস্থ্য প্লাটিফর্মের মাধ্যমে নারী স্বাস্থ্যসেবা এখন আগের চেয়ে অনেক সহজলভ্য হয়েছে। বিশেষ করে গর্ভবর্তী মায়েদের জন্য অনলাইন পরামর্শ ও স্বাস্থ্য সচেতনতা কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গ্রামীণ অঞ্চলে, যেখানে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কঠিন ছিল, সেখানেও মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাচ্ছে। WHO এর তথ্য অনুযায়ী, প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্যসেবার কারণে মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
নারীর সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষায় প্রযুক্তি
প্রযুক্তি শুধু শুধু নারীদের কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবায় সাহায্য করছে না, বরং নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার জন্যও কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সামাজিক মাধ্যমে নারীরা তাদের মত প্রকাশ করতে পারছেন এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার মাধ্যমে সমমনা মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারছেন। এছাড়া, বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ ও সেফটি ডিভাইস নারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষায় সাহায্য করছে, যেমন ‘SheSafe’ এবং ‘b5afe’ এর মতো অ্যাপ নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি: নারীর ক্ষমতায়নের নতুন অধ্যায়
ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নারীদের জন্য এক নতুন পথ তৈরি করেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে নারীরা কেবল নিজ নিজ গত্তিতে সীমাবদ্ধ নেই; তারা বৈশ্বিক বাজারের অংশ হতে পারছেন। এছাড়া, উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা আজ প্রযুক্তির সাহায্যে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। ‘ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম’ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০% ই-কমার্স উদ্দ্যোক্তা নারী, এবং এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। প্রযুক্তি যে নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তা নিঃসন্দেহে আধুনিক সমাজের অগ্রগতির প্রতিচ্ছবি। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সুরক্ষায় প্রযুক্তি নারীদের জন্য নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর নারীদের জন্য প্রযুক্তির এই অগ্রগতি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তাদের ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক অবস্থানকে উন্নত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। প্রযুক্তি যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে নারীর ক্ষমতায়নের যাত্রা আরও মসৃণ এবং সফল হবে, যা শুধু তাদের ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, গোটা সমাজেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।