মুক্তির সন্ধানে
তেরো বছর বয়সে মা আর ছোট ছোট দুই ভাই বোনের হাত ধরে দেশ ছেড়ে আসার সময়
আমার ঝোলার ভেতরে ছিল ছোট্ট পাতলা একটা কবিতার খাতা
প্রাইমারীতে জে. এম. সেন কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে পড়ার সময়
একুশের প্রভাত ফেরি সেরে এসে স্কুলে
অনুষ্ঠানে ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলাম
কোথায় গেল আমার তবে সেই স্বাধীনতা!
কোথায় গেল আমার তবে সেই সুখ!
ক্লাস সিক্সে চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল মডেল হাই স্কুলে সদ্য তৈরী হওয়া অডিটরিয়ামে স্বরচিত কবিতা পড়েছি
আবৃত্তির শিক্ষক কাজল স্যার পাশে এসে বলেছেন, ‘বাহ্! ভালো হয়েছে!আরো লিখে যাও ‘
লজ্জায় আমার মুখটা এইটুকুনি হয়ে গিয়েছিল
মা বলতো, যখনই দুঃখ হবে মনের কথা কবিতায় লিখে রেখে দেবে
আমিতো এতগুলো বছর ধরে জীবনের যত দুঃখ কষ্ট কবিতায় লিখে রেখে রেখে এসেছি
কৈশোরে দেশ ছেড়ে আসার পেছনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না
কৈশোরে এভাবে দ্বিখণ্ডিত হওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না
পেটে মারণ ক্ষুধা নিয়ে, আশ্রয়হীনের তাড়া খাওয়া
বিনীদ্র রাতে
কখনো কখনো কবিতার খাতার মত, মায়ের পাশে শুয়ে
স্বপ্ন দেখার অবকাশ না-থাকলেও, স্তব্দ
সব দুঃখ দূর হয়ে যেত
সেই মাকে হারানোর দুঃখ এখন তবে আমি আর লুকোবো কোথায়?
এতদিন ধরে যেসব কথা রূপকের আড়ালে লিখে রেখে রেখে এসেছি
মা চলে যাওয়ার পর থেকে সব আড়াল ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে
কবিতা সত্তা কি আর এভাবে আড়ালে আবডালে চেপে রাখা যায় ?
কবির জন্মগত সত্তা কবিতায় বারে বারে ফিরে ফিরে আসে
মাকে হারানোর পর থেকে উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা বড় বেশি দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে
আমার মা যে ছিল আমার হারানো স্বদেশ, আমার মাতৃভূমি
আমার মায়ের পায়ের তলায় ধুলোতে স্বদেশের ধূলো
দেশ ছেড়ে আসা উদ্বাস্তু কৈশোরের কবিতার খাতায়
প্রথম কবিতাটিই ছিল মাতৃভূমিকে নিয়ে
আমার মা যেন আমাকে এবার একটা চরম সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে গেলো
যে সত্য লিখে চলা ছাড়া কবির আর কোনো ত্রাণ নেই
যে সত্য লিখে চলা ছাড়া কবিতার আর কোনো মুক্তি নেই