প্রকৃত বন্ধু
আজ ও আমার রেখে যাওয়া বই ও খাতা, ক্লাসের শেষ বেঞ্চে পেলাম। প্রতিদিনই এ রকম হচ্ছে।আমি ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বই খাতা রেখে যাই, খুঁজতে খুঁজতে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে পাই।
আমার বাড়ি গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই লেখাপড়া করেছি। গ্রামের পরিবেশে ই বড় হয়েছি। স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায়।এটাই নিয়ম।কিন্তু কলেজের ছাত্ররা বই নিয়ে ক্লাসে যায় না এটা আমার জানা ছিলো না।
ভর্তি হলাম রাজেন্দ্র কলেজে একাদশ শ্রেণিতে বানিজ্য বিভাগে। আমাদের ক্লাস বেশির ভাগ হতো বানিজ্য ভবনের একশ দুই নম্বর কক্ষে। বিরাট কক্ষ।হ্যাণ্ড মাইক দিয়ে স্যারেরা ক্লাস নেন।আমি অবাক হতাম। আমরা বানিজ্য বিভাগে চারশত পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলাম। আমার রোল নং গুনে গুনে চারশ ছিলো। কলেজে নামে ছেলেদের কমই চিনতো। সবাই রোল বললেই সবাই সবাই কে চিনতো।
রাজেন্দ্র কলেজে আমরা যখন পড়তাম তখন মেয়েরা ছিলো না। শুধুমাত্র ছেলেদের কে একাদশে ভর্তি করতো। যার জন্য আমাদের কে বিধবা কলেজ বলে আখ্যায়িত করতো।কিছুদূর পূবের দিকে এগিয়ে গেলে অনাথের মোড় থেকে একটু হাঁটলেই সারদা সুন্দরী কলেজ। এই কলেজে শুধুমাত্র ছাত্রীদেরকেই ভর্তি করতে। ওদের ইউনিফর্ম ও ধবধবে সাদা। ওদের কে ও আমরা বিধবা বলতাম।
মাঝে মাঝে দুই বিধবারা চুরিচামারি করে এক হয়ে যেতাম।আমাদেরো বউ নাই ওদেরও জামাই নাই।
তাই দু’য়ে দু’য়ে এক হওয়া যাকে বলে।
নিয়মিত ক্লাস করতে ছিলাম। কলেজে ক্লাস যার যার ইচ্ছে অনুযায়ী করে। কেউ কারো খবর রাখে না। কেউ কারো ধার ধারে না।
স্কুলে প্রথম বেঞ্চে বসার অভ্যাস ছিলো।প্রথম বেঞ্চে বসলে স্যারের মুখ দেখা যায় ভালো। আর স্যার যা বক্তব্য দেন ভালো বোঝা যায়। আরেকটা সমস্যা ছিলো ফার্স্ট বেঞ্চে না বসলে না বসলে আমার ভালোই লাগতো না।
তাই বই, খাতা, কলম প্রথম বেঞ্চে রেখে যাওয়া। স্কুলেও আমরা রেখে যেতাম। একাদশ শ্রেণি মানেই সবে মাত্র স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া।
সেদিন আবার আমার বই খাতা শেষ বেঞ্চে পেয়ে
রাগে রাগে গরগর করে সামনের বেঞ্চে এলাম। দেখি অন্য কেউ সেখানে একটা খাতা রেখেছে।আমি ঐ খাতাটি পিছনের বেঞ্চে রেখে সামনের বেঞ্চে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর স্যার এলেন। স্যার লেকচার দিয়ে চলে গেলেন।
তারপর একজন ছাত্র এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমার খাতা পিছনে কে দিয়েছে।তখনো আমরা কেউ কাউকে চিনি না। সবেমাত্র নতুন কয়েক মাস কলেজে ভর্তি হয়েছি।
আমি বললাম আমি সরিয়েছি।
তুমি কেন সরালে?
আমার রেখে যাওয়া বই খাতা তুমি সরিয়েছ তাই।
তাই, আমার বই তুই সরাবি তোর এত বড় সাহস!
আমাকে চিনিস।
বলেই আমাই বই খাতা ফিক্কে দিলো। বই খাতা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলল।
আমি অসহায়ের মতো কাঁদতে বই খাতা আবার গুছিয়ে নিলাম।
বললাম তুমি আমার বই ফেললে কেন?
ও কোনো কথা না বলে আমার দুই চোয়ালে দুইটা কষে চড়থাপ্পড় মারলো।এবং বলল,ক্ষ্যাত কোথাকার
আমারে চিনোস। আমি তোরে খাইয়ে ফেলামু।
আমি ভয় ডর কি পেলাম জানি না। তবে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলাম।কষ্টে বুক ভেঙ্গে আসছিলো। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না। আমার সাথে এমন হচ্ছে কোন বন্ধুই প্রতিবাদ করলো না।কোনো বন্ধুই ঠেকালো না। কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুটি এগিয়ে আসলো। বলল, আমি তোমাকে চিনি।তোমার কি হয়েছে বলল।
আবার বলল, থাক বলার দরকার নাই।আমি দেখেছি। ও তোমাকে চড় মেরেছে। কেনো মেরেছে শুধু তাই বলো।আড়ষ্ট গলায় আমি সব ঘটনা বললাম।
যে ছেলেটি আমাকে মেরেছে ছেলেটির নাম বিশ্বজিৎ।জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলো। তারার মেলা স্কুলের পিছনে ওদের বাসা। বাবা পুলিশে চাকুরী করে।তাই তার এতো দাপট।
এগিয়ে আসা ছেলেটি বিশ্বজিৎকে সামনে ডাকলো। বিশ্বজিৎ কাছে আসতে না আসতে আমাকে বলল,তোমাকে যেভাবে চড় মেরেছে তুমি ও মারো।
আমার বুকে সাহস জন্মালো।
আর কোনো কথা না বলে দুই গালে দুটি কষে চড় মারলাম।
চটাস চটাস শব্দ হলো।
ছেলেটি বলল, শোধ বোধ।
এরপর আর যেনো ওকে কেউ বিরক্ত না করে। ও সামনের সীটেই বসবে।
গ্রামের ছেলে পেয়েছো। সহজ সরল পেয়েছো যা ইচ্ছে তাই করবে। ও আমার ভাই আজ থেকে চিনিয়ে দিলাম। কেউ যেনো ওকে কিছু না বলে।
বিশ্বজিৎ চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। ক্লাসের অন্য বন্ধুরা হা করে তাকিয়ে রইল।
আমাকে বলল, আমার সাথে এসো।একটা রিক্সা নিলো। রিক্সায় উঠলাম।
তখন বলল, আমার নাম জাকির।
তোমার সাথেই পড়ি।তুমি যেখানে থাকো তার পশ্চিম পাশের বাসা আমাদের। ওখানেই আমি থাকি। তুমি আমাকে চিননা কিন্তু আমি তোমাকে চিনি।তুমি আমার বন্ধু। পরিচিত হতে চেয়েছি অনেক আগেই। সময় হয়ে উঠেনি।
মনে রেখো এই শহরে দুর্বলদের কোনো জায়গা নাই।
দুর্বল হলে তোমাকে কেউ মানুষ মনে করবে না। তোমাকে মারিয়ে যাবে,তোমাকে পায়ের তলায় রাখবে। তোমাকে অত্যাচার করবে।
আজ যা হলো তা মনে রেখো না। এটাও ঠিক না।
ঠিক এই জন্যই যে তোমাকে আর কেউ আঘাত করতে আসবে না। তোমাকে অবহেলা করবে না।
জানবে তুমি একা নও আমি আছি। এই শহরে বাঁচতে হলে মেরুদণ্ড সোজা করে বাঁচতে হবে।
তোমার কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। আমি তোমার তোমার বন্ধু। দেহে এক বিন্দু রক্ত থাকতে তোমাকে কেউ বিপদে ফেলতে পারবে না। তুমি গ্রাম থেকে এসেছো। ভালো করে পড়বে। সমস্যা হলে আমাকে জানাবে। আমি তোমার সমস্যা সমাধান করবো। মনে করো এই শহরে তোমার একজন বন্ধু আছে। যা তোমার জন্য জীবন দিতে পারে।
আমার চোখে অঝোর ধারায় পানি বের হতে লাগলো।আমি জাকির কে জড়িয়ে ধরলাম।
রাতে আমি পড়তে ছিলাম জাকির আমার রুমে আসলো।পিছনে দেখি বিশ্বজিৎ। বন্ধু বলে বুকে জড়িয়ে সেই ধরলো। কতক্ষণে ছাড়লো।তার হিসেব নেই।