শীতের ভ্রমণে চায়ের দেশে
প্রকৃতি অপার হস্তে সাজিয়েছে সিলেটকে। বৃহত্তর সিলেটের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রূপ-লাবণ্যের অপূর্ব এক ভান্ডার। সিলেট না ঘুরলে ‘মুগ্ধকর বাংলাদেশ’ দেখা পরিপূর্ণ হবে না। পরিবার-পরিজন, বন্ধুদের নিয়ে শীতের ছুটি কাটানোর কথা ভাবছেন? চলে আসুন সিলেটে। ইট-পাথরের যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে হারিয়ে যান খানিক দূরে জল-ঝরনার মিতালীতে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেনো আপন হাতজুড়ে দেওয়া সিলেটের পর্যটনগুলো। সিলেটের অপার পর্যটন স্পটগুলোর চুম্বুক অংশ তুলে ধরা হলোঃ
রাতারগুল
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জলারবন (সোয়াম্প ফরেস্ট) রাতারগুল। চারদিকে নদী ও হাওর বেষ্টিত এ বনের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা হিজল-করচ গাছ। ৪ থেকে ফুট পানির মধ্যে ভাসা এই জলারবন দেখলে যে কারো ভালো লাগার কথা। ‘সিলেটের সুন্দরবন’ খ্যাত প্রায় ৩৩১ একর আয়তনের রাতারগুল বনে বর্ষাকালে পর্যটকদের ভিড় ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। তবে বর্ষা এবং ‘কোমর পানির’ মৌসুমে ঘোরার মধ্যে পার্থক্যটা এই দুই সময়ে এখানে না আসলে বোঝা মুশকিল। ডিঙিতে চড়ে বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ বনটি মূলত সাপের জন্য বিখ্যাত। ডিঙ্গিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই চোখে পরে যেতে পারে গাছে পেঁচিয়ে থাকা কোনো সাপ। আবার কপাল ভালো থাকলে দেখা হতে পারে একদল বানরের সাথে। তাছাড়াতো টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ির মতো নানান প্রজাতির পাখি বনের ভেতরে আপনার সঙ্গী হয়ে থাকছেই। জলের মধ্যে ভেসে থাকা সবুজ বৃক্ষ, মাথার উপর তার ছায়া, সুনীল আকাশ, নৌকায় করে রাতারগুলে ঘুরে বেড়ানো তো অদ্ভুত রোমাঞ্চকর এক অ্যাডভেঞ্চারই! ভেতরের দিকে জঙ্গলের গভীরতা অনেকটাই বেশি যে, সূর্যের আলো গাছের পাতা ভেদ করে জল ছুঁতে পারে না। নৌকায় ঘুরে আপনি পাবেন সীমাহীন আনন্দ।
বিছানাকান্দি
ওপারে ভারত আর এপারে বাংলাদেশের বিছনাকান্দি। ভারত থেকে প্রবল বেগে শীতল জলস্রোত ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে, মিশে যাচ্ছে বিছনাকান্দির রূপবতী নদীতে। স্রোতেরা বয়ে যাচ্ছে ছোট-বড় অসংখ্য পাথর পেরিয়ে। সেই পাথরে মাথা রেখে শীতল জলে গা ডুবিয়ে-ভাসিয়ে শুয়ে থাকছে মানুষ, ভাসিয়ে দিচ্ছে যাপিত জীবনের চিরায়ত ক্লান্তি- এটি বিছনাকান্দির এক নৈমিত্তিক দৃশ্য।কোথা থেকে এই স্বচ্ছ শীতল জলের উৎপত্তি, তা দেখার উপায় নেই মোটেই। পাথুরে জলে নিজেকে সঁপে দেয়া আপনাকে দেবে এক ভিন্ন প্রশান্তি, নিয়ে যাবে এক অপার্থিব জগতে। মেঘলা দিনে বিছনাকান্দি গেলে দেখা পেতে পারেন পাহাড়ের গায়ে ভেসে থাকা মেঘমালা। সুন্দরের ছড়িয়ে থাকাটা অবশ্য বিছনাকান্দির পথে পথে।
জাফলং
সুদৃশ্য পাহাড় চুড়া, স্বচ্ছ জলরশি আর নানান রঙের নুড়ি পাথরের এক অপূর্ব সমন্বয় সিলেটের জাফলং। নগর সভ্যতার যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে জীবন এখানে এসে মাথা লুকোয় একটু শান্তির খোঁজে। প্রকৃতির মায়াবী পরশে আনন্দে নেচে ওঠে মন। তাই শীতে ছুটিকে পরিপূর্ণ করে তুলতে যে কেউ আসতে পারেন পাহাড়, পানি ও পাথরভরা রূপকথার রাজ্য জাফলংয়ে। প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সারা দেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তুপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়।সীমান্তের ওপারে ভারতীয় পাহাড়-টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু পাহাড়ের গহীন অরণ্য ও প্রকৃতির শুনশান নীরবতা পর্যটকদের দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে।
পাহাড়ের গাঁ থেকে ঝড়ে পড়ছে অবিরাম ঝর্ণাধারা, জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলধারায় সাদা-কালো রং-বেরংয়ের বিভিন্ন আকৃতির পাথর, নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী খাসিয়া সম্প্রদায়ের ব্যাতিক্রমধর্মী বসত ঘর, জিরো পয়েন্টের ওমঘট নদীর উপর ভারতের ঝুলন্ত ব্রিজ, খাসিয়া জনগোষ্ঠীর পান চাষ, জাফলংয়ের মানুষের সহজাত বন্ধুতা আকৃষ্ট করে তুলবে আপনার ভ্রমণকে।
লালাখাল
জাফলং যাওয়ার পথে জৈন্তাপুর উপজেলার সারিঘাটের কাছেই অবস্থিত লালাখাল। নির্জন মনকাড়া লালাখালের স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর দুই ধারের অপরূপ সৌন্দর্য, দীর্ঘ নৌ-পথ ভ্রমণের সাধ যেকোনো পর্যটকের কাছে এক দুর্লভ আকর্ষণ। ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচে লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি থেকে এ নদী বাংলাদেশে প্রবাহিত। প্রকৃতি তার আপন হাতে একান্ত খাতির করে রূপ-সৌন্দর্যের সবটুকু দিয়ে সাজিয়েছে এ স্থানটিকে। পাহাড়-টিলা-অরণ্য আর নদী যেন ব্যতিক্রমী মিতালী পাতিয়েছে এখানে। সারি নদী লালাখালের প্রাণ। প্রাচীনকালের কোন এক সময়ে রূপের টানে দুর্গম পাহাড়ি দুরাঞ্চল হতে ছুটে এসেছে সারি, মিলিত হয়েছে লালাখালে, নিজের পাতানো মিতালীকে সে যেন করেছে আরও নিখুঁত আর আকর্ষণীয়।
পানতুমাই
বাংলাদেশের কোল ঘেঁষে প্রতিবেশী ভারতের মেঘালয়ের গহীন অরণ্যের কোলে বাংলাদেশ পানে নেমেছে অপরূপ এক ঝরণাধারা। সুউচ্চ পাহাড় থেকে নেমে আসছে জলরাশি। সফেদ জলধারা লেপ্টে আছে সবুজ পাহাড়ের গায়ে। দেখলে মনে হবে সবুজের বুকে কেউ হয়তো বিছিয়ে রেখেছে সাদা শাড়ি। ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা এই ঝরণাধারাটি স্থানীয়ভাবে মায়ামতি ও ফাটাছড়া ঝরণা হিসেবে পরিচিত। আর পর্যটকদের কাছে জলপ্রপাতটির পরিচিতি ‘পাংথুমাই ঝরনা’ নামে।পাংথুমাই সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের একটি গ্রাম ‘পাংথুমাই’। পেছনে মেঘালয় পাহাড় এবং বয়ে চলা পিয়াইন নদীর পাড়ে এই গ্রামটি সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামগুলোর একটি। এই গ্রামের পাশেই বিশাল ঝর্ণা ‘ বড়হিল’। সন্ধ্যাটা পাংথুমাইয়ে কাটিয়ে মনভরে শ্বাস নিতে চলে আসুন সিলেটে। নাগরিক জীবনে পরবর্তী ভ্রমণের আগে এই শ্বাসটাই যেন অন্তরে গেঁথে থাকে।
ভোলাগঞ্জ
শহর থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৩৩ কিলোমিটার। ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত সরাসরি কোনো যানবাহন চলে না। তাই পর্যটকরা সিলেট থেকে টুকেরবাজার পর্যন্ত যাত্রীবাহী বাস অথবা অটোরিকশা-যোগে যাতায়াত করতে পারেন। টুকের বাজার থেকে ভোলাগঞ্জ পর্যন্তও রয়েছে একই বাহন। সেখানে পাথর কোয়ারি ও সাদা পাথর ঝরনা দেখে প্রাণ জুড়াবে যে কারো।
লোভাছড়া
সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলায় অবস্থিত মনোমুগ্ধকর অপূর্ব এই সৃষ্টি। প্রকৃতি যেখানে তার সৌন্দর্যের মোহ ছড়ায়! রাঙ্গামাটির মতোই একটি ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে এই লোভাছড়ায়। ব্রিজটি নির্মিত হয় ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে। পাহাড়ের মেঘের প্রতিচ্ছবি, যেন হাত দিয়েই ছোঁয়া যাবে মেঘ! চা বাগানে সবুজ কুঁড়ি, কচি ছেলে-মেয়ের নিষ্পাপ চাহনি, চা শ্রমিকদের জীবনাচরণ, ব্রিটিশ আমলের ক্বিন ব্রিজ, নদীর বুকে পাল তোলা নৌকার ভেসে চলা, নদী তীরের জীবনযাত্রা কতো কি দেখার সুবর্ণ সুযোগ!
মালনীছড়া চা বাগান
ওপরে বড় বড় ছায়া বৃক্ষ। নিচে আধো আলো আধো ছায়ায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ চাদর। যেন শৈল্পিক কারুকাজ। সিলেটের চা-বাগানের এ প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকের মন ছুঁয়ে যায়।১৫০০ একর জায়গার ওপর অবস্থিত উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়ায় পর্যটকদের কাছে আরেক বিস্ময়। সিলেটের চায়ের রঙ, স্বাদ এবং সুবাস অতুলনীয়। বর্তমানে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে চা বাগান পরিচালিত হয়ে আসছে। চা বাগানের পাশাপাশি বর্তমানে এখানে কমলা ও রাবারের চাষ করা হয়। এই বাগানের পাশেই বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্টেডিয়াম। মালনীছড়া চা বাগান ছাড়াও সিলেটে লাক্কাতুরা চা বাগান, আলী বাহার চা বাগান, খাদিম আহমদ টি স্টেট, লালাখান টি স্টেট, বরজান টি স্টেট উল্লেখযোগ্য।
উতমাছড়া
সারি সারি নীল পাহাড়ের কোলে পাথর বিছানো বিস্তৃত এলাকায় জলের ছুটাছুটি। পাহাড়ের বুক চিরে বের হয়ে আসা ঠাণ্ডা পানির স্রোত। যা আপনাকে দু’হাত প্রসারিত করে আলিঙ্গন করবে সব সয়মই। বিছনাকান্দির কথা বলছি না । এতদিনে বিছনাকান্দি হয়তো আপনাদের ঘুরে আসা হয়েছে অনেকবার। এবার ঘুরে আসতে পারেন বিছনাকান্দির চেয়েও সুন্দর নতুন আরেকটি পর্যটন স্পট। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে শোভিত অপরূপ এই লীলাভূমির নাম উতমাছড়া। প্রকৃতির অসাধারণ রূপ-লাবণ্যে ঘেরা এই স্থানটি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উত্তর রণিখাই ইউনিয়নে অবস্থিত। গরমের অস্বস্তি থেকে প্রকৃতির কোলে শান্তি পেতে চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন উতমাছড়া থেকে। সিলেটের মানুষের কাছে জায়গাটি অপরিচিত হলেও এখানে আপনি পেতে পারেন প্রকৃতির মনোরম লাবণ্যের স্পর্শ।
এছাড়াও হযরত শাহজালাল (রা.) জিয়ারত শেষ করে সেখান থেকেই লেগুনা অথবা সিএনজিতে যেতে পারেন হযরত শাহ পরাণ (রা.) এর মাজার শরীফে। ভাড়া নেবে মাত্র ১৫ টাকা। শহরের অভ্যন্তরেই ঘুরে দেখতে পারেন-ঐতিহাসিক নিদর্শন শাহী ঈদগাহ, হাসন রাজা জাদুঘর, খান বাহাদুর জিতু মিয়ার বাড়ি, মনিপুরী রাজবাড়ি, মনিপুরী মিউজিয়াম, ওসমানী জাদুঘর ও শিশু পার্ক। শহর থেকে খানিকটা দূরে মালনী ছড়া ও লাক্কাতুড়া চা বাগান, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেবের বাড়ি, হরিপুরের আগুন টিলা এবং কৈলাশ টিলা। এছাড়া সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মাধবকুণ্ড ও হামহাম জলপ্রপাত, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এর বাড়ি, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট, শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া উদ্যান, বাইক্কা বিল, শীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা ছাড়াও অসংখ্য চা বাগান।
সুনামগঞ্জে টাঙ্গুয়ার হাওর, শাহ আব্দুল করিমের বাড়ি, ও হবিগঞ্জের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে সাতছড়ি, রেমাকালেঙ্গা, এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং। সিলেট ঘুরে গেলে সাত রঙের চায়ের স্বাদও নিতে পারেন।
যেভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকার সায়দাবাদ বা ফকিরাপুল থেকে সিলেটগামী বাসে সিলেটের কদমতলীতে পৌঁছাতে পারেন। খরচ পড়বে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে। আর সিলেট শহর থেকে সব গুলো পর্যটন । ট্রেনে সিলেট পৌঁছাতে খরচ পড়বে সাড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তবে দেশের বেশিরভাগ জায়গা থেকে সরাসরি সিলেটগামী বাস,ট্রেন রয়েছে। চাইলে নিজের এলাকা থেকেও আসতে পারেন। এছাড়াও আকাশপথে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
থাকবেন কোথায়
সিলেট মহানগরীর জিন্দাবাজার-বন্দরবাজার-দরগাগেইট এলাকায় প্রচুর আবাসিক হোটেল আছে। আছে কয়েকটি বিলাসবহুল হোটেলও। সাধারণ মানের হোটেলে প্রতিদিন থাকার খরচ পড়বে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা। বিলাসবহুল হোটেলে ১ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এছাড়া সামর্থ্য অনুযায়ী অল্প খরচের মধ্যে ভালো হোটেলে থাকতে পারবেন। আর খাবারের জন্য সিলেটে বিখ্যাত রেস্টুরেন্টগুলোতে অল্প খরচে পাবেন মজাদার খাবারের স্বাদ।