Skip to content

৮ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র ‘রূপসা নদীর বাঁকে’

‘রূপসা নদীর বাঁকে’ দেখলাম অনেকটা সময় পেরিয়ে আসার পর l বালি রবীন্দ্রভবনে পাঁচ টাকায় সিনেমা দেখতাম একসময় । তরুণ মজুমদার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষের সব ছবি, প্রায় আট দশমাস পর রবীন্দ্রভবনে আসতো, ততদিনে পত্রপত্রিকায় আলোচনা সমালোচনা পড়া হয়ে যেত প্রায় । আলোচনার সাথে ছবিকে মিলিয়ে নিতে কিছুটা সুবিধায় হতো ।

‘রূপসা নদীর বাঁকে’, গবেষণা তানভীর মোকাম্মেল, লেখা তানভীর মোকাম্মেল, নির্দেশনা তানভীর মোকাম্মেল l ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল দেশে বিদেশে ভিন্ন রুচির কিছু দর্শক, ভক্ত, অনুরাগী তৈরি করে ফেলতে পেরেছেন ।

তানভীর মোকাম্মেলের প্রতিটি চলচ্চিত্র প্রায় এক ধরণের গবেষণা । ‘লালন’ দেখতে গিয়ে আমার একটু বুঝতে সুবিধা হয়েছিল । আমি তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্ধ ভক্ত । ‘মনের মানুষ ‘ পড়ে ফেলেছি । গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে চোখে জল চলে এলো । আমি সুনীলকে আমার লালন সাঁই ভাবতে শুরু করেছিলাম । এর আগে নিজের কাজের জন্য বাউল দর্শন, সুফি দর্শন নিয়ে কিছু আকর গ্রন্থ পড়া হয়েছিল । তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালন’ দেখতে গিয়ে বুঝলাম, জীবনে অনেককিছু অপূর্ণ থেকে যেতো, না-দেখলে ।

সুনীলের গবেষণামূলক অন্য সব লেখার মতো ‘মনের মানুষ ‘ও বাস্তব এবং সাহিত্যের রসসিক্ত কল্পনার মিশেল । শিক্ষক তানভীর মোকাম্মেল, সাহিত্যিক তানভীর মোকাম্মেল গোটা জীবনকে, জীবন দর্শনকে হুবহু তুলে ধরার চেষ্টা করেন । লালন সাঁইয়ের আখড়ায় না-গিয়েও এই ভাবধারা নিজের মধ্যে চারিয়ে ওঠে ছবি দেখতে দেখতে ।

‘রূপসা নদীর বাঁকে’ অবিভক্ত ভারতের এক বামপন্থী কর্মীর জীবনী । যাদের কথা ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যায়, যাদের কথা কেউ বলে না, নিজের শিল্পী সত্তার দায়িত্ববোধ থেকে তানভীর মোকাম্মেল ধরে রাখার চেষ্টা করেন । বর্তমান বাংলাদেশে একসময় উচ্চবিত্ত হিন্দুরাই অনেককিছুর নেতৃত্বে ছিলেন । মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তেমনই এক শীর্ষস্থানীয় বামপন্থী নেতা । যাঁর হাত ধরে বামপন্থী আন্দোলন সংগঠিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ।

মানব মুখার্জি ধর্মটর্ম মানেন না, জাতপাতে বিশ্বাস রাখার প্রশ্নই নেই । কারারুদ্ধ থাকাকালীন মাতৃবিয়োগ হলো, ছোট ভাই সৎকার কর্ম বাকী সব করবেন । মানব বাবু আসেন, দেখেন, পুনরায় ফিরে যান । বামুন পরিবারের ছেলে গ্রামের সহজ সরল মানুষের কাছে তবু তাঁর পরিচয় ‘কমরেড ঠাকুর ‘।

এই কমরেড পার্টি লাইনও সবসময় মেনে চলেন না । মুসলিম লীগের পাকিস্তানপন্থীদের অত্যাচারে দলে দলে হিন্দুরা দেশ ছাড়তে শুরু করেছে । পার্টি লাইন ছিল কিছুতেই দেশ ছাড়া যাবে না । দেশের মাটিতে লড়াই করে অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে । মানব বাবু পার্টি লাইনের বাইরে এসেও এমনকি নিজের সহকর্মীরা পর্যন্ত যারা দেশ ছাড়তে চেয়েছেন, সকলের সহমর্মী হয়েছেন । নিজে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই দেশ ত্যাগ করেননি ।

পার্টি নেতারা ঘুরে ঘুরে শুধু তত্ত্ব কথা শুনিয়ে যায় । মানব মুখার্জি প্রয়োজনে অঞ্চলের অবস্থা বুঝে অঞ্চলের কথা বলতে বলেন । জন হেনরির গানের চাইতেও অঞ্চলের কৃষকদের তৈরি করা, কৃষি জাগরণের গান কৃষকদের সংঘবদ্ধ করতে সমর্থ হয় । তেভাগা আন্দোলন ফলিত ফসলের তিন ভাগের মধ্যে এক ভাগ জমিদারের, দু ভাগ কৃষকের পরিচালক দৃশ্যগুলো খুব সুন্দর ফুটিয়ে তোলেন ।

তানভীর মোকাম্মেলের ডায়েরি পড়তে গিয়ে দেখেছি, একপেশে কথা তিনি কখনো বলেন না । সে তিনি যত বড় মানুষই হোন না কেন । যাঁর যা ভালো লাগে তা উল্লেখ করেন, আবার ভালো না-লাগা কথাটিও খোলাখুলি বলেন । চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাথে আলাপের অনেক স্মৃতি উল্লেখ করেছেন । আবার বুদ্ধদেব নিজেকে নিজে সেরা পরিচালক বলতে চেয়েছেন, তার সমালোচনা করেছেন ।

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ‘সীমান্তরেখা’ ছবিতে যে কথা গুলো বলেছেন, ভালো দিক গুলোর প্রশংসা করেছেন , কিছু কথার আবার একটু সমালোচনা করেছেন । বামপন্থী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সীমান্তে পতাকা ওড়ানোর সময় গীতা শ্লোক পাঠ করেছিলেন । আবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর গায়ককে প্রথম শ্রেণীর বলার জন্য ভালো অর্থ দাবী করেছিলেন এবং নিয়েছিলেন, ডায়েরিতে সেই শোনা কথাও উল্লেখ আছে ।

‘রূপসা নদীর বাঁকে ‘ চলচ্চিত্রের মধ্যেও ব্রিটিশ আমল, বিশ্ব পরিস্থিতি, মুসলিম লীগের উত্থান এতো কিছুর মধ্যে থেকে একজন বামপন্থী কর্মীর গণ আন্দোলন । শেষ পর্যন্ত সেই বামপন্থীরাও পিছিয়ে পড়ে আওয়ামীলীগের কাছে । এই সব দিকগুলো প্রায় আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে উঠে আসে চলচ্চিত্রের ভাষায় । জমিদার যখন নোনা জল ঢুকিয়ে দিয়ে চাষিদের ফসল নষ্ট করে দিচ্ছিল, মানব মুখার্জি গ্রামের মানুষকে দিয়ে বাঁধ তৈরি করেছিলেন ।

কমিউনিস্ট আন্দোলন সফল হোক বা না-হোক, এই বাঁধ তৈরির ইতিহাসটিও তো হারিয়ে যেত, যদি না তানভীর মোকাম্মেল ধরে রাখতেন । ছোট ছোট মানুষের জীবন কথা এভাবেও হয়তো কখনো কখনো বড় বড় মানুষের ইতিহাসের পাশে থেকে যায় ।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ