নারী দিবস এবং কাপুড়ে বাবুর এক দিনের কলম-পেষা
নিত্য দিনের ভোগান্তি পোহানোর শেষে যখন কোনো কাপুড়ে বাবু তার কলম-পেষার কাজটি নিষ্ঠাবানের অনুকরণে করেন, তখন মনে হয় না যেন কত দিন ধরে অভুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কাপুড়ে বাবু হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি নিজে যে ব্যক্তিটি না, সেই ব্যক্তিটি হওয়ার চেষ্টা করেন।
অর্থ্যাৎ, কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি তাঁর রক্ষিতার আত্মহত্যার দায়ভার বহন করতে চান না, কিন্তু কোনো একভাবে বিশিষ্ট সমাজসেবামূলক একটি পুরুস্কার জিততে যান। আর তাঁর কলম-পেষা হলো সেই কাজ, যে কাজ তিনি অন্তর্নিহিত স্বভাবে বহন না করলেও দেশব্যাপী সেই কাজটির সিলমোহর নিদারুণ নিয়মে বয়ে চলে।
অনেক ভারী-ভারী সাঁজোয়া শব্দ ব্যবহারের চেয়ে সহজ করেই বলা যাক। ধরুন, আপনি আপনার আশপাশের যে বিশিষ্ট ব্যক্তিকে চেনেন, উনি একজন বিশিষ্ট বউপিটানো ভদ্রলোক। প্রায় প্রতিদিন তাঁর ঘরে নির্যাতনে এলাকাবাসীর ঘুম হারাম হওয়ার অবস্থা। অথচ, তিনি কিন্তু একজন সম্মানী ব্যক্তি। তাঁকে শ্রদ্ধা করার মতো কিংবা ভয় পাওয়ার মতো অনেক ব্যক্তিই চারপাশে বিরাজ করে। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিকেই বলে কাপুড়ে বাবু।
আর তিনি যখন এলাকা আর মসজিদ তহবিলে নারী ও শিশুর অধিকারের কথা বলে বড় বড় বুলি আওড়ান, তখন সেটা হলো তাঁর কলম-পেষা।
এই নিষ্ঠুর অর্থনৈতিক শ্বাসনতন্ত্র এমনই। অর্থ যার বুলি তার। এই বুলি আওড়ানোর জন্য সাধের আসনপাতা লোকেরাও যে এমনটি বিশ্বাস করেন, সেটা তাদের যাবতীয় বাহবা আর কার্যক্রম দেখলেই নিশ্চিত হওয়া যায়।
ঠিক তেমনই আমাদের নারী দিবসের উদ্যাপনের হিঁড়িক। কাপুড়ে বাবুদের হঠাৎ করে মার্চ মাসের ৫/৬ তারিখের দিকে মনে পড়ে একটি নিছক অনুভূতিশীল কাজের কলম-পেষা পালন করতে হবে৷ তখন তাঁরা নিজের সমস্ত মনোবল একত্র করে একেকটি দামি হল ভাড়া করে নারীদের জন্য একটা জায়গা তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ, বছরে একবারই তো। এই জায়গা তৈরি করার কাজ তো আর রোজ রোজ তৈরি করে দিতে হয় না।
কর্মক্ষেত্রে, ঘরে, বাইরে, রাস্তাঘাটে, বাসস্টপে, বন্ধুদের আড্ডায় লিঙ্গবৈষম্য তো একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাই। ৩৬৪ দিন নিজের হাতে জব্দ করে একটা দিন নারীদের জন্য দিতে কিই-বা আর এমন আপত্তি থাকতে পারে।
কিন্তু গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে কিন্তু বছরে এক দিন নারীদের জন্য একটা স্বাধীন ভূখণ্ড দেওয়ার কথা কোথাও বলা হয়নি। বরং, এই দেশের সংবিধানে প্রতিটি মানুষ সমান সমান রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোগ করবে, এটাই তো তার নিয়ম।
কিন্তু কে আর মানে কার কথা? সংবিধানের নিয়মের চাইতে এখানে সামাজিক মানদণ্ড আর পারিপার্শ্বিকতার চাপাচাপি বেশি শোভনীয়। আর ব্যক্তিগত অনুভূতি তো আছেই।
ব্যক্তিগত অনুভূতির কারণেই মূলত এত সামাজিক মানদণ্ডের সৃষ্টি। কিন্তু এই সব নিয়ম-কানুনের কল্যাণে না বন্ধ হচ্ছে নারীর প্রতি সহিংসতা, না ঠেকানো যাচ্ছে পাবলিক প্লেসে যৌন হয়রানির মতো জঘন্যতম কাজ। না বন্ধ হচ্ছে পৈশাচিক বর্বর ধর্ষণ।
এই মার্চ মাসেই গণধর্ষণ আর আর শিশুধর্ষণের খবরে টিভি আর খবরের কাগজ খোলা যায় না। আর আন্দোলন এবং বিচারব্যবস্থা? কে থামায় এই ধর্ষকদের? তারা ক্ষমতার যে অপব্যবহার করছে, সেটা তো বহু বছরে লাই পেয়ে মাথায় ওঠার ফল। ধর্ষকরা নিজেদের ক্ষমতা আর দাপটের জেরে প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারণ, তারা জানে যে এই সমাজ পরোক্ষভাবে হলেও একজন ধর্ষকেরই পৃষ্ঠপোষকতা করবে।
এই পৃষ্ঠপোষকতার নমুনা নানা রকম। ইদানীং এক অন্ধকার যুগের আবহ প্রকাশ পাচ্ছে সমাজে৷ সেটা হলো ভিক্টিম ব্লেইমিং। যে ভিক্টিম, তার পূর্বের ইতিহাসনামা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করলে অনেকে মনে করেন, তারা একজন সৎ চরিত্রবান ব্যক্তির তালিকা থেকে বুঝি বাদ পড়ে গেলেন। আবার অনেক নারী নিজেরাই আরেক নারীর বিরুদ্ধে নানা কটূকথা বলে সেই নারীর মানহানি করার চেষ্টা করেন। একজন নারী যদি নিজের মেরুদণ্ড শক্ত করে নিজের ঢাল নিজেই চালাতে চান, তাহলে তাঁর জন্য নেমে আসে সহস্র বাধাবিপত্তি।
নারী হিসেবে অমুক করা যায় না, নারীর জন্য সম্মানজনক পেশা কী, নারীর গলার আওয়াজের ডেসিবল কত- এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় নিয়ম-কানুন ঠিক করে দেয় এই সমাজ। বিনিময়ে সে কী পাচ্ছে, জানি না। অন্তত, পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে এটা বোঝা যায়৷ কিন্তু এই ধরনের মনোভাব যে নিজ নিজ বিকলাঙ্গতার প্রকাশ করে, এই বিষয়টি সম্পর্কে কি তারা অজ্ঞ?
সব ক্ষেত্রে বাধা আর শৈশবের যৌন হয়রানি বয়ে নিয়ে চলতে হয় প্রায় প্রতিটি মেয়েকেই। এর জন্য না আছে কোনো মানসিক স্বাস্থ্য-উন্নয়ন বিষয়ক ব্যবস্থা, না আছে পাশে থাকার মতো পরিবারের কেউ। শুধু বাধা-বিপত্তি আর যৌন-হয়রানিই না, মানসিকভাবে চূড়ান্ত অপদস্ত হয়ে যান নারীর বয়সের সাথে৷
কত নারী যে নিজের বয়সকালে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভোগেন, সেটা হাতে গোনার মতো সংখ্যার পর্যায়ে আর নেই৷ কারণ, নিজের কোনো ভালোলাগা-মন্দলাগা সমস্তই বাদ দিয়ে যে তিনি শুধু সংসারের হাল ধরে জীবন কাটিয়ে দিলেন, সেটার একটা ভার বহন তো তাঁকে করতে হবে একদিন।
কর্মক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের সমান সমান পারিশ্রমিক এখনো সব জায়গায় নেই। অনেকে নারী বলে চাকরি প্রত্যাখ্যান করে দেন। কারণ, সব কাজ তো নারীরা করতে পারেন না। নারীরা ওয়েট লিফটিং পারেন, এভারেস্ট জয় করতে পারেন আর বাইরে ঘুরে ফিল্ড-ওয়ার্ক নারীরা করতে পারবেন না? চরম রসিকতা ছাড়া আর কী এটা!
হতে পারে নারীরা সিদ্ধান্তহীনতায় অনেক বেশি ভোগেন। নারীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন না৷ কারণ, ছোটবেলা থেকে তাঁকে সব পরিবারে এই শিক্ষা তো দেয়া হয় না, যে তাঁকে বড় হয়ে কেবল ঘরের বউ না, মানুষও হতে হবে।
যা-ই হোক, নারী দিবসে নারীদের প্রতি আমোদে-প্রমোদে ভরপুর কিছু অনুষ্ঠান টিভি এবং বিভিন্ন সম্প্রচারে দেখা যাবে, কিন্তু এই সব সম্প্রচারে অংশগ্রহণকারী সবাই কি নারীদের মানুষ বলে বিবেচনা করেন? অনেকে করেন, সত্যিই তাঁরা চান, বছরে এক দিন নারীর জন্য একটা ভূখণ্ড তৈরি করতে করতে হয়তো নারীর জন্য সারা পৃথিবী স্বাধীন ভূখণ্ডে পরিণত হবে। নারীরা নিজেদের দেশকে নিজের অধিকারের জায়গা মনে করতে সক্ষম হবে৷ নারীকে নারী হওয়ার কারণে হয়তো প্রতিনিয়ত এত এত অবমাননাকর এবং বর্বরোচিত ঘটনার শিকার হতে হবে না৷
কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করতে হলে এই সব কাপুড়ে বাবুদের আঁস্তানায় অর্ঘ্যদান করা বন্ধ করতে হবে। কাপুড়ে বাবুরা যত দিন ক্ষমতার দাপটে নিজেদের অন্যায়ের বৈধতা নিশ্চিত করবে, তত দিন এই নারী দিবস বছরে এক দিনের জন্যই পালিত হবে। নারীদের স্বাধীন ভূখণ্ড আর হবে না।