Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাত

মেয়ের বাবা হয়ে মহাবিপদে পড়েছেন ইকরাম সাহেব। বিপদে পড়াটাই স্বাভাবিক। অষ্টাদশী শিক্ষিত রূপবতী মেয়ের বাবা। প্রতিদিন ঘটকরা এসে ঘোরঘোর করে বিভিন্ন পাত্রের ছবি আর বায়োডাটা নিয়ে। তিনি যতই বলেন, এখনই মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন না। নাছোড়বান্দা ঘটকরা তার পিছু ছাড়ছে না। একটার পর একটা পান চিবিয়ে মিষ্টিমুখে বলবে, অমুক ছেলে শিক্ষিত সুদর্শন। তমুক পাত্র বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। এই ছেলের চৌদ্দগোষ্ঠি লন্ডন আমেরিকায়। সেই ছেলেটি বড় চাকুরী করে। এমন ভালো-ভালো পাত্রের ঢাকঢোল প্রায়ই পিটিয়ে যায় ঘটক-বাহিনী।

ঘটক-বাহিনীর ঢাকঢোল ইকরাম সাহেব কানে ঠাঁই না দিলেও অন্তরি বেগমের কান ঠিকই ভারী করে তুলেছে। ভারী হওয়াটাই স্বাভাবিক। মেয়ের মা বলে কথা। খুব সাদামনের মহিলা। মানুষের প্রতি ভালোবাসার সাগর। ঘটকদের তুষ্ট রাখতে যাতায়াত খরচ আর চা পানের টাকাটাও ঠিকভাবে মিঠল কিনা তলেতলে খেয়াল রাখেন তিনি। কথায় আছে 'দয়ায় আপদ বাড়ে।' বেশি দয়ালু হওয়ায় আপদবিপদেরও শেষ নেই। কোনো ভিক্ষুক দরজায় এলে টাকা বা চাল-ডাল তো দেবেনই। পেট ভরিয়ে ভাত খাইয়ে দিতেও ভুলেননি তিনি। তাই দরজার সামনে ভিক্ষুকের ঝামেলাও কম পোয়াতে হয় না। অতিথি এলে তো কথাই নেই। আদরের অন্ত থাকে না অন্তরি বেগমের। অন্তরি বেগমের কাছে ঘটকরাও একেকজন মহান অতিথি হিসেবে গণ্য। একমাত্র মেয়ের জন্য ভালো-ভালো পাত্র খুঁজছেন যারা তাদের মন তো খুশি রাখতেই হবে।

রাতের বেলা। শোবার ঘরে। ইকরাম সাহেবের সাথে অন্তরি বেগমের আলাপ- 

'ওগো, ঘটকরা এত কষ্ট করে আমাদের একমাত্র মেয়ের জন্য এতগুলো ভালো ছেলের সন্ধান দিচ্ছে। তোমার কি একটি ছেলেও পছন্দ হয়নি?'
'হয় অন্তরি, হয়।'
'তাহলে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছো না কেন?' 
'মেয়ের বিয়ে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়েছো কেন বলো তো? মেয়েটা আরো কিছু পড়াশোনা করুক না।'
'এত পড়াশোনা দিয়ে কী হবে শুনি? মেয়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে মাস্টারি করবে নাকি?' 'মাস্টারি না করলেও ডেগমাস্টারি তো করবে।' 'মেয়েমানুষ বলে কথা। স্বামীর ঘরে গিয়ে ডেগমাস্টারি তো করতেই হবে। এর জন্য কি মেয়ের বিয়ে দেব না?'
'দেব গো দেব। এর জন্যই আরো কিছু পড়াশোনার দরকার।'
'কীজানি বাবা! তোমার সবকথাতেই ইয়ার্কি অবহেলা! এসব শুনতে ভাল্লাগে না আমার!'
'একটু বোঝার চেষ্টা করো গিন্নী। বাচ্ছামেয়ে। সংসারের কী বোঝে সে? পড়াশোনা করলে বুদ্ধি বাড়বে। শারীরিক পরিপক্বতা আসবে। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সবার সাথে মানিয়ে চলার বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু বাড়ুক না মেয়েটার। রান্নাবান্নার কিছু তালিম দাও ওকে। আদর দিয়ে তো কোনোদিন চুলোর কাছেই যেতে দাওনি।' 
'আমাকে দোষ দিচ্ছো? তোমার আদরের চাক্কা মেয়ে কি চুলোর কাছে যায়? তুমি ওকে কোনোদিন কোনো কাজ করতে দিয়েছো?' 
'এবার ওকে রান্নাঘরে নাও। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রান্নাবাড়া করতে হবে না? রান্নাবান্না হচ্ছে একটা শিল্প। বিশেষ করে মেয়েদেরকে সেটা জানতেই হবে।' 
'ঠিক আছে গো-ঠিক আছে। আমি ওকে সব শিখিয়ে নেব। এবার বলো, তুমি মেয়েটার জন্য একটা ছেলে পছন্দ করবে?' 
'আচ্ছা বাবা করব। তোমাকে নিয়েই করব। এবার এককাপ কড়া লিকারের চা দাও তো।' 
'এতরাতে চা খাবে তুমি? তুমি তো রাতে চা খাও না। রাতে চা খেলে তোমার ঘুম হয় না।' 
'আজ খাব। খুব মাথা ধরেছে।' 
'ঠিক আছে আমি তোমার জন্য চা করতে যাচ্ছি।'

ইকরাম সাহেবের ঘুম হয়নি সারারাত। মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবনার পাহাড় চেপে বসেছে মাথায়। অতি আদরের একমাত্র মেয়ে শ্বশুরালয়ে চলে যাবে? কোন ঘরে যাবে? কী আদর পাবে? ছেলেটি কেমন হবে? শ্বশুরশ্বাশুরি নিজের মেয়ের মতন দেখবে কী? বড় অংকের টাকা আর বড় বাড়ি থাকলেই কী সবার মন বড় হয়? ভাবনা আর ভাবনা…! ভাবনার সাগরে সারারাত হাবুডুবু খেলেন তিনি। মেয়ের বিয়ে, এবং ভালো নিয়ে ভাবতে-ভাবতে ফজরের আজান হয়ে গেল। মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠ, 'আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম'। ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম। ঘুম তো হলোই না। ধীরে-ধীরে মসজিদের দিকে রওয়ানা দিলেন।

নামাজ শেষে বাসায় এলেন। কোরান তিলাওয়াতে বসবেন। বারান্দায় বসে মেয়েকে ডাকছেন, 
'সুরাইয়া, সুরাইয়া মা…।' 
চোখ কচলিয়ে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সুরাইয়ার জবাব, 'জ্বি বাবা।' 
'ঘুম থেকে ওঠো মা। ফজরের নামাজ পড়তে হবে না?' 
'উঠছি বাবা।' 'ওজু করে নামাজ পড়ে নাও।' 
'আচ্ছা বাবা।' 
'আজ তোমার হাতের চা খাব মা।' 
'ওকে বাবা। আমি নামাজ সেরে তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি।'

সুরাইয়া চুলোয় চায়ের পানি চাপিয়ে ওজু করে নামাজ সেরে নেয়। বাবার জন্য চা নিয়ে যায়। বাবা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে, মিষ্টি হেসে বললেন, 'মা আমার পাক্কা রাঁধুনি হয়ে গেছে। মাথাটায় হাত বুলিয়ে দে মা। রাতে ঘুম হয়নি।' সুরাইয়া বাবার পিঠঘেষে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এটা তার অভ্যাস। সবসময় করে। বাবার কাছে গেলেই মাথায় হাত বুলাবে। পাকাচুল ছিঁড়বে। মাথা চুলকিয়ে দেবে। বাবা ভারী গলায় সুরাইয়াকে বলছেন, 'তোর মা তো তোকে বিয়ে দেবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তোর মতামত কীরে মা?' বাবার মুখে একথা শুনে সুরাইয়ার চোখেমুখে লজ্জা, খুশি আর রাগের মিশ্রণ ফুটে ওঠে। সকালের সূর্য কেবল উঁকি দিতে যাচ্ছে। সূর্যের চেয়েও লাল দেখাচ্ছে সুরাইয়াকে। লজ্জায় লাল। রাগে লাল। খুশিতে লাল। বাবার মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে, কোন মেয়ে লজ্জা না পায়? সুরাইয়ার লাজুক মুখের কাছে যেন সকালের শিশিরস্নাত লজ্জাবতীও হার মানবে। খুশির কাছে যেন সূর্যের হাসিও মলিন দেখাচ্ছে।

বাবার মাথায় হাত বুলাতে আঙুল কাঁপছিল। বাবা সুরাইয়ার মুখের দিকে না তাকালেও বুঝতে পারছিলেন, ওর মনের অবস্থা কেমন হবে? বাবা আবার বললেন, 
'কিছু বল মা।' 
সুরাইয়া হালকা রাগীস্বরে বলল, 'তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছো বাবা? আমি তোমাদের উপর বোঝা হয়ে গেছি?' 
'নারে মা। এভাবে বলছিস কেন? সব মেয়েরাই স্বামীর ঘরে যায়। তুমিও যাবে। এটাই তো নিয়মরে মা।' 
'তুমি না স্বপ্ন দেখতে বাবা? আমি পড়াশোনা করে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াব। তারপর আমার সংসার নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না। এসব ভুলে গেছো বাবা?' 
'ভুলিনিরে মা। ভুলিনি। আর ভুলিনি বলেই আজ তোকে নিয়ে আমার এত ভাবনা। তোর মায়ের এত ভাবনা।' 
'কিসের এত ভাবনা শুনি? আমি কি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি?' 
'নারে মা। আমি তো বলি, তোর এখনো বিয়ের বয়সই হয়নি।' 
'তাহলে কেন মিছেমিছি এত ভাবছো? আর ভেবে-ভেবে নিজের শরীরটা খারাপ করছো?' 
'এই শরীরটার জন্যই এত ভাবছি মা। আমার বয়স হয়েছে। বুঝতে পারছি বেশিদিন বাঁচব না। কখন কী হয়ে যায় খোদাই জানেন।' 
'প্লিজ বাবা! এসব বলো না!' সুরাইয়া বাবার ঠোঁট চেপে ধরে।
'বেঁচে থাকতে তোকে একটা ভালো পাত্রস্থ করতে পারলে আমার ভালো লাগবে মা। প্রয়োজনে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাকি পড়াশোনাটা সেরে নেবে। আমি যে ছেলেকেই পছন্দ করি না কেন তোর পড়াশোনার বিষয়ে এই আবদারটা রাখব।' 
'বাবা তুমি ভালো থাকো। তুমি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকব। আমি গেলাম বাবা।' 
'তোর মাকে একটু ডেকে দে মা। আমার জন্য তোর মাও ঘুমায়নি রাতে। তাই তোর মা'কে ডাকিনি আমি।'

ইকরাম সাহেব স্টাডিরুমে কোরান তিলাওয়াত করবেন। স্টাডিরুমটা একটা বিদ্যার সাগর। এই সাগরপাড়েই অবসর সময় কাটান তিনি। সারাদিন পড়ে থাকেন বই নিয়ে। বইয়ের ভাষায় কথা বলেন তিনি। শুদ্ধ উচ্চারণ। শুদ্ধ সুরেলা উচ্চারণে কোরান তিলাওয়াত করছেন। শুদ্ধ হবারই কথা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মানুষ। জীবনে হাজার-হাজার ছাত্র পড়িয়েছেন। মানুষ বানিয়েছেন। এদের অনেকেই দেশে বিদেশে ভালো অবস্থানে আছেন। শুধু আমিই পড়ে রইলাম অজোপাড়াগাঁয়ে সাধারণ কবি পরিচয়ে। স্যার আমাকে দেখলে আজও বলেন, তুমি আমার কাছে আজও সেই গাধা ছেলেটি। তাই তোমাকে ছাড়া আমার আর কোনো ভরসা খুঁজে পাই না। এই যা, স্যারের কথা বলতে বলতেই স্যারের ফোন। ফোন রিসিভ করে সালাম দিলাম। 
'আসসালামু আলাইকুম স্যার।' 
'ওয়ালাইকুম আসসালাম। কবি সাহেব নাকি?' 
'জ্বি স্যার।' 
'আগামী শুক্রবার জুম্মার পরে তুমি আমার বাড়িতে আসতে পারবে?' 
'পারব স্যার।' 
'তুমি তো মনভোলা মানুষ। ভুলে যাও বেশি।' 
'না স্যার। ভুলে যাব না।' 
'তোমাকে নিয়ে ভয় হয়। স্কুলের পড়া ভুলে যেতে আর এখন কেউ কিছু বললে সেটাও ভুলে যাও। হা হা হা! আচ্ছা শুনো, আগামী শুক্রবারে আমার বাড়িতে কিছু মেহমান আসবেন। আমার সুরাইয়ার বিয়ের ব্যপারে কথা বলবেন তারা। মানে সুরাইয়াকে দেখতে আসবেন। আমি একা মানুষ। তোমার খালাম্মা তো রান্নাঘরেই ব্যস্ত থাকবে। তুমি পাশে থাকলে আমাদের অনেক হেল্প হবে। ভুলে গেলে চলবে না। আমি খুলে বললাম, যাতে তোমার মনে থাকে। এবার রাখি।'

বরপক্ষ সুরাইয়াকে দেখতে আসবে শুনে, বুকটা কেমন জানি ধপ্পাস করে উঠল! সুরাইয়া আমাকে দেখলেই লাজে মুখ লুকায়। কেন? লজ্জা পাবে কেন? তাহলে কী…! তাহলে কি সুরাইয়াও আমাকে ভালবাসে? সুরাইয়ার লাজুক মুখটা দেখলেই আমার মনে ছন্দ জাগে। সেদিনও সুরাইয়াকে দেখে চারলাইন কবিতা লিখেছিলাম, 
'লজ্জা তোমার ঘোমটা রূপের 
কেউ দেখুক না কেউ
দেখলে তোমায় নয়ন জুড়ায়
জাগে প্রেমের ঢেউ।'
কেন নয়ন জুড়ায়? প্রেমের ঢেউ জাগে কেন? আমি কি সুরাইয়াকে ভালোবাসি? ভালোবাসি তো। আমি সুরাইয়াকে ভালোবাসি। আমার বুকের ভালোবাসার কথা সুরাইয়াকে বলতে পারছি না। বলতে যাব কেন? সেকি বোঝে না? হয়ত বোঝে। যদি বোঝে, বলছে না কেন? হয়ত বলবে। কবে বলবে? আদৌ কি বলবে? মেয়েরা এসব বলে? ওদের নাকি বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না। আমারই তো বলা উচিত। কীভাবে বলি? আমাকে কি সেভাবে দেখে সে? না দেখলে লজ্জা পাবে কেন? লজ্জা নারীর ভূষণ। হয়ত এমনি লজ্জা পায়। না। বলা উচিত হবে না। বলব না কোনোদিন। শরৎচন্দ্র বলেছেন, 'বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।' আমার ভালোবাসা তো ছোট নয়। আমি সুরাইয়াকে দূর থেকেই ভালবেসে যাব।

শুক্রবারে জুম্মার নামাজ পড়েই চলে গেলাম ইকরাম স্যারের বাড়িতে। স্যার আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। হাসিমুখে বললেন, ভাবছিলাম তোমাকে একবার ফোন দেব। এর আগেই তুমি চলে এলে। আর কোনো চিন্তা নেই আমার। শুনো, মেহমানরা আসলে তোমার খালাম্মা আর আমি তাঁদের রিসিভ করব। তুমিও আমাদের সাথে থাকবে। বসার পর তাঁদের সাথে আমি তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেব। আরে আমার একজন প্রিয় ছাত্র দেশের নামি কবি! এটা ওদের জানাব না? হা-হা-হা-! চা নাস্তা পরিবেশনের কাজটা তোমার হাতে করবে। এবার যাও তোমার খালাম্মার মেনু দেখে আসো। সুরাইয়া কেমন সাজগোজ করেছে! একটু দেখে নিও। হা-হা-হা…!

সুরাইয়া সাজবে আর আমি দেখব না? নয়ন জুড়িয়ে দেখব। একবার দেখব? মোটেই না। বারবার দেখব। শতবার দেখব। হাজারবার দেখব। সুরাইয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকব। সুরাইয়ার চোখে চোখ রাখব। ওর চোখে আমার ছবি দেখব। যদি লজ্জা পায়? লজ্জা পেলে ভালো। লজ্জায় লাল হয়ে যাক। আমি তার লাজুক মুখটাই বেশি দেখতে চাই। যদি কাঁদে? কাঁদুক। আমি ওর অশ্রু মুছে দেব। ওর অশ্রুতে আমিও সিক্ত হব। সিক্ত তো হয়েই গেছি। হৃদয়-সিক্ত হয়েছি। বেদনার অথৈ জলে রীতিমত সাঁতার কাটছি আমি। আমি দেখব। 
এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো? এ দেখাই শেষ দেখা হয়তো।

 

বিকেল প্রায় চারটার সময় কালোরঙের একটা দামি হাইয়েস গাড়ি এসে থামল ইকরাম স্যারের বাড়ির সামনে। ইকরাম স্যার আর খালাম্মা দ্রুত এগিয়ে গেলেন মেহমানদের রিসিভ করতে। সালাম দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলেন। কোমলকণ্ঠে আসুন প্লিজ, আসুন, আসুন, বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। ড্রয়িংরুমে বসলেন। স্যার  আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, আমার এক প্রিয় ছাত্র। ভালো লেখালেখি করে। দেশের বেশ পরিচিত একজন কবি। আপনারা তো দেশের বাইরে থাকেন নতুবা নাম বললেই আশা করি চিনতেন।

 

আমি মেহমানদের সালাম দিলাম। আমি বুঝতে পারলাম, বরপক্ষ দেশের বাইরে থাকেন। লন্ডন বা আমেরিকা-প্রবাসী হবেন। খালাম্মা চলে গেলেন রান্নাঘরে। আমিও খালাম্মার পিছুপিছু গেলাম। প্রথমেই ঠাণ্ডা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন শুরু। তারপর ডাইনিং টেবিলে মিষ্টি-মিঠাই, পিঠা-পায়েস, দইসহ বিভিন্ন ফল সাজিয়ে রাখার কাজটা করে নিলাম। কাজের ফাঁকে বারবার সুরাইয়াকে দেখলাম। সুরাইয়া মন খারাপ করে বসেছিল। মন খারাপ কেন ভাবছিলাম। আজ তার খুশি লাগার কথা। মনেমনে ভাবলাম আর বারবার তাকালাম। দেখলাম। কিছু বলার সাহস পেলাম না। 

 

খাওয়াদাওয়া শেষ। ডাইনিং টেবিল ছেড়ে আবার ড্রইংরুমে বসা হল। এবার আমাকে চা আর ড্রিংকস পরিবেশন করতে হল। পরিবেশন করলাম খালাম্মার হাতে সাজানো বাহারি পানদানিও। বরপক্ষ তাড়া আছে বলে মেয়ে দেখার আশা ব্যক্ত করল। স্যার বললেন, আপনারা কষ্ট করে আমার বাড়িতে এসেছেন কিছু সময় বসুন গল্প করি। আমার বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখুন। সম্পর্কে কে কি হন সেটাইতো এখনো জানা হল না। ঘটক পান চিবাতে-চিবাতে বলল, এই দুজন আপনার হবু বেয়াই-বেয়াইন। ওই দুজন হলেন বরের ভাই-ভাবী। আর উনি হচ্ছেন আপনার হবু জামাতা। স্যার হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। জামাইবাবার ছবি আমি দেখেছি। আজ সরাসরি দেখলাম। জামাইবাবাজি খুব সুদর্শন। আমার মেয়ের সাথে মানাবে বেশ। 

খালাম্মা সুরাইয়াকে নিয়ে ধীরে-ধীরে এলেন। সুরাইয়া কোমলকণ্ঠে সবাইকে সালাম দিল। সালামের উত্তর উপেক্ষা করে হবু শ্বশুর-শাশুড়ি সুরাইয়াকে বসতে বললেন। সুরাইয়া বসল। বরপক্ষের সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। কী যেন একটা বোঝাপড়া করে নিলেন তারা। শাশুড়ি-মা ওঠে এসে সুরাইয়ার মাথা থেকে কাপড় সরালেন। সুরাইকে দাঁড়াতে বললেন। মাথা নিচু করে ওঠে দাঁড়াল। শাশুড়ি সুরাইয়ার চুলের ঘনত্ব আর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ পরখ করলেন। সুরাইয়াকে একটু হাসতে বললেন। লজ্জায় হাসতে পারছিল না। শাশুড়ি নিজের হাতেই সুরাইয়ার ঠোঁট-দুটোকে উঠিয়ে নামিয়ে উপরের আর নিচের মাড়ির দাঁতগুলো দেখে নিলেন। তারপর বললেন একটু হাঁটো তো মা। এমন দৃশ্য দেখে আমি খুব অবাক হলাম। স্যার আর খালাম্মার মুখের দিকে তাকালাম। দুজনের মুখেই বিরক্তির ছাপ ভেসে উঠল। স্যার যেন চুপেচুপে রাগে কাঁপছিলেন। আমার কাছে মনে হল, বরপক্ষের লোকেরা যেন গরুর বাজারে আসছেন। যাক মেহমানদের সম্মানে চুপ থাকাই ভদ্রতা বলে ভেবে নিলাম। 

 

শাশুড়ি-মা সুরাইয়াকে বসার অনুমতি দিলেন। সুরাইয়া আবার বসল। বাঁকাচোখে হবু স্বামীর দিকে তাকাল। ভদ্রলোক মোটা একটা স্মার্টফোন টিপাটিপি করছিলেন। বারবার ম্যাসেঞ্জারে পটাস-পটাস শব্দ হচ্ছিল। আমি ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম, তিনি নেটে মগ্ন। কারো সাথে চ্যাট করে যাচ্ছেন। সুরাইয়া মাথা নিচু করে চোরাইচোখে তার হবু বরকে দেখে নিচ্ছে বারবার। বরটা একবারও সুরাইয়ার দিকে তাকাল না।  আমি ক্রিকেট মাঠের আম্পায়ারের মতো প্রখর দৃষ্টিতে ঘটনাটির ঘনঘটা অবলোকন করে যাচ্ছি। প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি, সুরাইয়া কখন আমার দিকে তাকায়? তাকাবে বলেই বিশ্বাসের বন্ধনে বড্ড পরিকর আমি। সবার চোখকে ফাঁকি দিতে গিয়ে আমার আঁখিতে আঁতকে ওঠে সুরাইয়া। লজ্জার ছন্দ মাত্রা অনুপ্রাস ছড়িয়ে পড়ে তার সারাবদনে। লাজুকমুখে আবার তাকাল। কী এক নিদারুণ অসহায়ত্বের দৃষ্টি। দৃষ্টি থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মত দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে এলো দু'গাল বেয়ে। ঘোমটার আঁচলে মুখ লুকাল সুরাইয়া। বরপক্ষের এতসব অভদ্রতার মাঝে বরটাকে আরো বেশি অভদ্র বলেই মনে হল আমার কাছে।

 

সুরাইয়ার হবু শ্বশুর বললেন, একটুকরো কাগজে তোমার নাম আর বাবা মায়ের নাম লিখে দাও তো মা। খালাম্মা সুরাইয়ার হাতে খাতাকলম দিলেন। সুরাইয়া মাথা নিচু করে আস্তে বলল, ইংরেজি নাকি বাংলায় লিখব? বরপক্ষ থেকে উত্তর আসল ইংরেজিতে লিখো। সুরাইয়া লিখল, 
Name- Suraya Akter
Fathers name- Ekramul Haque
Mothers name- Antari Begum
ঘটক সুরাইয়ার হাত থেকে খাতাটি নিয়ে শ্বশুর সাহেবের হাতে দিল। খাতাটি দেখেই তিনি বললেন, বাহ্! হাতের লেখাতো অসাধারণ! তিনি পড়লেন। ভুরু কুচকিয়ে খাতাটি ওনার স্ত্রীর হাতে দিলেন। এক হাত থেকে অন্যহাতে গেল। সবার হাত হয়ে আবার শ্বশুরের হাতে এলো।

 

সুরাইয়ার শ্বশুর-মশাই ইকরাম স্যারকে বললেন- 
'বেয়াই, যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব।'
'না না কিছু মনে করার কী আছে? বলুন কী বলতে চান?' 
'মেয়ের হাতের লেখার তারিপ না করে পারছি না।' 
'ধন্যবাদ বেয়াই খুব খুশি হলাম।' 
'আপনাকেও ধন্যবাদ। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আপনাদের জাত কী?' 
'জাত?' স্যার খুব বিস্মিত হলেন!
'হ্যাঁ, জাত।' 
'মানুষ।' 
'মানুষ তো সবাই। বলছিলাম, মেয়ের হাতের লেখায় আপনাদের নামের আগে বা পরে কোনো টাইটেল দেখছি না।' 
'ও আচ্ছা। টাইটেল? টাইটেল একটা ছিল বেয়াই। আমার বাপচাচারা নামের শেষে 'খান' লিখতেন। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা সেই টাইটেলটি ব্যবহার করছি না। আর সবাই মানুষ হলেও সত্যিকারে মানুষ সবাই নয়। সবাই যদি মানুষ হতো তাহলে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য এত চেষ্টা আর ত্যাগ স্বীকার করতাম না।' 
'হাসালেন বেয়াই। স্বাধীনতার সাথে টাইটেলের কী সম্পর্ক? আপনি সম্ভবত আমাকে নীতিকথা শুনিয়ে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করছেন।' 
'দেখুন বেয়াই সাহেব। আপনি আমার বাড়ির মেহমান। আপনার সাথে আমিও প্রাণখোলা হাসতে চাই।' 
'বিয়েশাদির বিষয় হাসি দিয়ে চলে কি? আপনি সত্যিকথা বললে আমরা খুশি হব। আমি আমার সোনার টুকরো ছেলের জন্য একটা ভালো জাতের মেয়ে খুঁজছি।' 
'তা খুঁজেন। আমি বলি, ব্যবহারেই বংশের পরিচয়।' 
'আমি আপনার নীতিকথা শুনতে আসিনি ভাই।' 
'হা হা হা! কেন আসছেন সেটা তো আমি জানি ভাই।' 
'জানেন যখন, এটাও জেনে নিন, চৌধুরীবাড়ির ছেলেমেয়েরা জাত বংশ দেখেই বিয়েশাদি করে।' 
'আপনিও জেনে নিন ভাই, আমি আমার মেয়েকে একজন ভালো মানুষের ঘরে বিয়ে দিতে চাই। কোনো টাইটেলের ঘরে নয়।' 
'আমরা এখন উঠবো ভাই। বিয়ে হচ্ছে সারাজীবনের একটা বন্ধন। এই কাজটা সম্পন্ন করার আগে অনেক ভেবেচিন্তে করতে হয়। পরের তিক্ততার চেয়ে আগের তিক্ততা ভালো। আপনি মানি মানুষ। আমার কথায় মন খারাপ করবেন না। আপনার মেয়েকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। শুধু মেয়ে পছন্দ হলেই হবে না। মেয়ের জাত বংশও দেখতে হবে। ভালো হতে হবে। আমরা এবার আসি। আসসালামু আলাইকুম।' 
'ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বী আসুন।'

 

মেহমানরা ওঠে দাঁড়ালেন। স্যার আর খালাম্মাও বসা থেকে উঠলেন। সুরাইয়া মাথা নিচু করে বসেই রইল। মেহমানগণ এক-এক করে ঘর থেকে বেরুলেন। স্যার আর খালাম্মাও মেহমানদের সাথে বেরুলেন। মেহমানদের সম্মানের সাথে বিদায় দেবেন। বিদায় দিতে কিছুটা এগিয়ে দেবেন। গাড়ি পর্যন্ত যাবেন তারা। আমি এখনো আমার স্থানেই অনড়। মেহমানদের সেবায় নিজেকে আর নিয়জিত করলাম না। কেন করলাম না নিজেও জানি না। কেন দাঁড়িয়ে রইলাম বুঝতে পারিনি। কেমন জানি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম।

 

আমার সামনে শুধুই সুরাইয়া।  সুরাইয়ার সামনে আমি। আমি নির্বাক হয়ে সুরাইয়াকে দেখছি। কান্না সামাল দিতে পারছে না সে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সুরাইয়ার লজ্জা দেখেছি। হাসি দেখেছি। রাগ দেখেছি। আজ তাকে কাঁদতে দেখলাম। হৃদয় ভাঙা নীরব কান্না। সুরাইয়ার হৃদয় কতটা ভেঙেছে? কেন ভেঙেছে? আমি জানি না। তবে আমার হৃদয়ে যে ঝড় বইল তা সামাল দিতে পারলাম না। রীতিমত লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলাম। কী বলব ভাষা খুঁজে পেলাম না। একবার শুধু বললাম, কাঁদছো কেন সুরাইয়া? সুরাইয়া বারবার অশ্রু মুছে কী যেন বলার চেষ্টা করছিল আমাকে।  

 

(সমাপ্ত)

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ